ড. মোঃ আবু হাসান:
বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার কর্মকর্তা, অর্থনীতির শিক্ষক ও গবেষক
অর্থনীতিতে ‘টানেল প্রভাব’ আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের শিকার ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবর্তিত সহনশীলতা বুঝতে মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। কল্পনা করুন, আমরা সকলেই একই দিকে যাচ্ছে এরকম একটি দুই লেনের সুড়ঙ্গে গাড়ি চালাচ্ছি এবং বিশাল জ্যামে আটকে আছি। হঠাৎ আপনার পাশের লেনের গাড়িগুলো চলতে শুরু করলো; আপনি আশাবাদী হলেন এই ভেবে যে, যাক! জ্যাম শেষ, একটু দেরি হলেও আমিও যেতে পারবো। কিন্তু, অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর আপনি বুঝতে পারলেন স্বাভাবিক নিয়মে টানেলের জ্যাম থেকে আপনার পরিত্রাণ নাই। প্রশ্ন হলো, আপনি কি আমৃত্যু এই জ্যামেই আটকে থাকতে চান? পাশের লেনের ফাউল খেলা দেখেও আপনি অন্তত ঈর্ষান্বিত হবেন না? ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবেন না? অগ্রগতির দ্বারপ্রান্তে থাকার বিষয়ে আপনার আশাবাদ কখন পিছিয়ে থাকার ক্রোধে পরিণত হবে।
আমি যে ক্রান্তিকালে লেখাটি শুরু করেছি ততদিনে দুর্বল শিক্ষা ব্যবস্থায় গড়ে উঠা জেন-জি প্রজন্মের নেতৃত্বে এই ভূখণ্ডের সবচেয়ে ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থানের তিন মাস মাত্র পেরিয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সর্বজনস্বীকৃত সৃষ্টিশীল বাঙালি ড. মুহাম্মদ ইউনূস বারংবার যেটাকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। অথচ, ইতিহাসের অন্যতম বড় সম্ভাবনা যখন টানেলের শেষে আলোকবিন্দুর মতো দৃশ্যমান হয়েছে ঠিক তখনই আত্মঘাতীদের হাত ধরে মরীচিকায় মিলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। অগ্রগতির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এই জাতির আশাবাদ ১৯৪৭ থেকে বারেবারে পিছিয়ে থাকার ক্রোধের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। পরিহাসের বিষয় এই যে, বিজয়ের মুনাফা ক্যাশ করার অমার্জনীয় ব্যর্থতা এবং পরিশেষে টানেলের জ্যামে আমৃত্যু আটকে থেকে পাশের লেনের গাড়িগুলোকে এগিয়ে যেতে দেখার একরাশ হতাশা যেন এই জাতির ললাট-লিখন হয়ে আছে। এ জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে ১৯৭২-১৯৭৫ সময়কালেই; যাকে তুলনা করা যায় স্রষ্টার হাতে সৃষ্টির মৃত্যু হিসেবে। স্বাধীনতার পূর্বেই বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক হার্ডওয়?্যারটিতে বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, সাম্য ও মানবিক মর্যাদার আধুনিক পরীক্ষিত সফটওয়্যার ইন্সটল করতে ব্যর্থ হন। পরবর্তী ৩ বছরে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও গুম, নির্বাচনে নোংরা হস্তক্ষেপ, বণ্টনজনিত চরম অব্যবস্থাপনার কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ এবং সবশেষে একদলীয় বাকশাল কায়েমের কারণে শেখ মুজিবের জাতির পিতার মুকুটও বিবর্ণ হয়েছিলো।
তর্কাতীতভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সফলতম অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের বিজয় ঘরে তুলে লাইনচ্যুত বাংলাদেশকে গ্লোবালাইজেশন ও লিবারালাইজেশন নামক উদ্দীপকের সাহায্যে ইমার্জিং উন্নয়নশীল বাংলাদেশে পরিণত করেছিলেন। কিন্তু, রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাসের সুযোগে শূন্য দশকের শেষাংশে প্রণবদের মতো আত্মস্বীকৃত বিদেশি চক্রান্ত, এদেশীয় মিডিয়া মুঘল এবং সুশীল সমাজের অমার্জনীয় ব্যর্থতায় ইমার্জিং বাংলাদেশ নামক অসীম সম্ভাবনাময় দ্রুতগতির ট্রেনটিকে টানেলে ঠেলে দেওয়া হয়। এরপর সর্বপ্রথমে শেখ হাসিনা সুচতুরভাবে গণতন্ত্র হত্যার মাধ্যমে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের অসীম সম্ভাবনাকেই গলাটিপে হত্যা করে উন্নয়নের ট্রেনটিকে লাইনচ্যুত করে। বাংলাদেশের তথাকথিত তাবৎ বুদ্ধিজীবী, মিডিয়া হাউস ও সাংস্কৃতিক কর্মীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন ও সহায়তায় নব্য স্বৈরাচার পরিণত হয় ফ্যাসিস্টে।
চৌর্যতন্ত্রের সকল উদাহরণকে লজ্জায় ডুবিয়ে পরবর্তী এক দশকে বাংলাদেশকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো সেই তলাবিহীন ঝুড়ির পর্যায়ে। নিম্নবিত্ত সমাজের ৪ কোটি ১৭ লাখ মানুষকে চরম দারিদ্রে রেখে অলিগার্ক সমাজ সৃষ্টি করে তার শিখরে দানবরূপে বসে জনগণকে বারবার বিদ্রূপ করে গেলো। মধ্যবিত্তকে নিম্নবিত্তে পরিণত করে চেতনার নেশায় আসক্ত করে ট্যাগিং নির্ভর বিভাজনের নোংরা খেলা চালিয়ে কৃত্রিম ডাটা আর উন্নয়নের মিথ্যা বুলি প্রচার করে গেলো অবলীলায়। চেতনার আফিমে মত্ত হয়ে বদ্ধ টানেলে আটকা পরা দেশের অধিকাংশ মানুষ পাশের লেনের ৫% গাড়িগুলোকে চলতে দেখেও পিছিয়ে থাকার ক্রোধ ভুলে রইলো। ট্রিকল ডাউন থিওরির অসারতা প্রমাণিত করে এবং নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এর বক্তব্য ‘এউচ ৎবভষবপঃং হড়নড়ফু’ং ৎবধষরঃু’ প্রমাণ করে বাংলাদেশ তার ইতিহাসের সর্বোচ্চ আয় বৈষম্যের পর্যায়ে রূপান্তরিত হলো। উপরন্তু, বাংলাদেশ বিশ্বমঞ্চে ‘অতি ধনী’ বৃদ্ধির তালিকায় প্রথম এবং ‘অতি গরিবের’ তালিকায় পঞ্চম স্থানে উঠে আসলো। জনগণের কাঁধে প্রায় শত বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ চাপিয়ে দিয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার অলিগার্ক দোসররা সম্পদের ‘জনগণের অংশটুকু’ লুট করে শত বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করলো। পিলখানায় বিডিআর বাহিনীকে ভোঁতা করে, দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে, একের পর এক দেশবিরোধী গোপন চুক্তি করে ও রোহিঙ্গা সঙ্কটে অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে দেশের নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিলো। প্লাস সিলিং তত্ত্বের গিনিপিগ বানিয়ে সিভিল সার্ভিসের অন্য সকল ক্যাডারকে বৈষম্যের চূড়ায় নিক্ষেপ করলো আর পুলিশ ও প্রশাসন ক্যাডারকে সকল অন্যায় সুবিধা দিয়ে দলীয় ক্যাডারে পরিণত করলো।
পাঠ্যবই থেকে সর্বত্র ২৪দ্ধ৭ মুজিববাদের টিকা নিতে নিতে ইমুউনিটিপ্রাপ্ত হয়ে যে প্রজন্ম মাত্র বারো ঘণ্টাও এক ইস্যুতে আটকে থাকতে পারে না, সেই সামাজিক মাধ্যম নির্ভর জেন-জি প্রজন্ম ফ্যাক্ট চেকারের সাহায্যে মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিববাদের ফারাক বুঝে নিলো নিমিষেই। তারা লক্ষ্য করলো স্বৈরাচার থেকে ফ্যাসিস্টে পরিণত হওয়া শেখ হাসিনা তার শেষ পেরেকটা ঠুকেছে জেন-জি প্রজন্মেরই কফিনে। মানবসম্পদ উন্নয়নে বিশ্বের প্রায় সর্বনিম্ন; এমনকি, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন ব্যয় করে জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকালের অযুত সম্ভাবনা দুপায়ে মাড়িয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনা জেন-জি প্রজন্মের সাথে ক্রমাগত বিদ্রূপ করে গেলো। শিক্ষাক্রম নিয়ে একের পর এক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নকল প্রথার পুনঃপ্রচলন, প্রশ্ন ফাঁস, শিক্ষকদের পাস করাতে বাধ্য করানো, এমনকি অটোপাস করিয়ে হলেও ৯০% জেন-জি প্রজন্মকে ন্যূনতম গ্রামের কলেজে ডিগ্রি বা উপজেলার কলেজে অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রী বানিয়ে ক্লাস রুমে আটকে রাখা হলো। পরিণতিতে, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৪ কোটি ৫৯ লাখ কর্মহীন তরুণ ও যুবক রেখে, কর্মে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর ৮৫% কে অনানুষ্ঠানিক পেশায় রেখে, উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের উচ্চহার নিয়ে বাংলাদেশকে পর্যায়ক্রমে কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি ও আয়হীন কর্মসংস্থানের দেশে রূপান্তর করলো।
২৪ এর বিজয় বাংলাদেশ নামক এই ভুখণ্ডের নাগরিকদের যেন টাইম মেশিনে চাপিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে ছেড়ে দিয়েছে। হার্ডওয়্যার একই মডেলে রয়ে গেছে যেটাতে অকেজো সফটওয়্যার রিসাইকেলে পাঠিয়ে আধুনিক ও টেকসই সফটওয়্যার ইন্সটল করার বিপুল সুযোগ ও সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। কিন্তু পরিহাসের বিষয় এই যে, শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ও মানবসম্পদ উন্নয়ন নামক উদ্দীপকের সাহায্যে উন্নয়নের গতি টেকসই করার কোনও উদ্যোগ ও সম্ভাবনা এখনও পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু, জনপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহত্তম শিক্ষা ক্যাডারের কোনও প্রতিনিধি ছাড়াই জনপ্রশাসন সংস্কার কমিটি গঠন করে শিক্ষা খাতকে বরাবরের মতোই অবহেলা করা হয়েছে। আর তাই একজন সিভিল সার্ভিসের নিবেদিত কর্মকর্তা, শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে আমি অগ্রগতির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো জেন-জি, আলফা ও তাদের পরবর্তী অনাগত প্রজন্মের দ্রুতগামী অথচ টেকসই উন্নয়নের আশাবাদকে টানেলের শেষের আলোক বিশুর মতোই মরীচিকায় মিলিয়ে যেতে দেখছি। কারণ মানবিক মুল্যবোধবিবর্জিত বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ‘নিজের ভালো পাগলেও বুঝে নামক প্রবাদ বাক্যটিকে মিথ্যা প্রমাণিত করে একটি সম্মিলিত আত্মঘাতী প্রজন্ম গড়ে তুলেছে। ন্যূনতম রিকনসিলিয়েশনে অবিশ্বাসী আওয়ামী কাল্টের এই অনুসারীরা জেনোসাইডকে অপরাধ মনে করে না। হাজারো গুম- খুন, সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস, দেশ বিরোধী লুটপাট ও পাচার, গোপন চুক্তি, এবং সর্বশেষ হাসিনাপুত্র জয় কর্তৃক দেশের মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য তথা সকল মানুষকে বিক্রির পরেও ১৫ বছর কানা ও বোবা হয়ে থাকারা বুঝতে পারছে না কার্ত্তিক্ষত সংস্কারের অন্তত একটিও সফল হলে নিজের ও অনাগত প্রজন্মের ভবিষ্যৎ অতীত ও বর্তমান অপেক্ষা মধুর হবে। এরা দেখে না মুজিবকন্যা হাসিনা পরিবারের সকল সদস্যের জন্য উন্নত দেশে ফার্স্ট হোম নিশ্চিত করে বাংলাদেশকে অবিরত ভিসঔন করেছে। এরা বুঝতে চায় না, নিজ হাতে জাহান্নাম বানানো দেশে, নেতা-দল-কর্মী ও দেশের সকল মানুষকে মবের মধ্যে ছুড়ে ফেলে দূরতমও পরিজনসহ পালিয়ে যাওয়া কেউ স্বেচ্ছায় ফেরে না। মুজিববাদ নামক কাল্টের আফিমে ডুবে থাকা এই ইরেশনাল ও আত্মঘাতী ব্যঙালির সাথে যুক্ত হয়েছে একটা অধৈর্য ও অস্থির প্রকৃতির চিরায়ত জনগোষ্ঠী যারা দুঃসময়ে অনন্তকাল অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয় না কিন্তু সুসময়ের সুসংবাদ পেয়ে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করতে রাজি না। অর্থনীতির টানেল প্রভাব’ অনুসারে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের শিকার এই উভয় শ্রেণির ক্ষতিগ্রস্তদের সহনশীলতা অসীম। সুতরাং, বৈশ্বিক মানদণ্ডে অত্যন্ত দুর্বল আত্মঘাতী মানব সম্পদের বোঝাটিকে নামিয়ে রেখে বর্তমানের অসীম সুযোগকে ক্যাশ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টেকসই ও উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের সম্ভাবনার আলো জ্বালিয়ে রাখতে হবে। এজন্য, ইতিমধ্যে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলো প্রয়োজনীয় কিন্তু অপর্যাপ্ত। শিক্ষা সংস্কার কমিশন হলো বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র সংস্কারের পর্যাপ্ত শর্ত। প্রয়োজনীয় সংস্কার কমিশনগুলোর পাশাপাশি অতীব জরুরি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করলেই কেবল জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকালের প্রায় হারিয়ে ফেলা সম্ভাবনাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে এবং রাষ্ট্র সংস্কার সম্পূর্ণ ও টেকসই হবে। অতীতে প্রাপ্ত জাতীয় জীবনের অধিকাংশ সুযোগ ও সম্ভাবনা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়ে আমরা প্রায়শই অনুশোচনা করে থাকি। জেন-জি আমাদেরকে নিষ্ক্রিয় থাকার পরিবর্তে এই ভুখণ্ডের গণমানুষের সম্মিলিত আকাৎক্ষাগুলি অনুসরণ করার জন্য প্ররোচিত করেছেন যাতে পরবর্তীতে অনুশোচনা না করতে হয়।