Monday , February 17 2025

বালু ও পাথরের অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলন স্থায়ী ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে!

কামরুন নাহার:

কালামা লেখক:
বালু ও পাথরের অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলন সাধারণত নদী, পাহাড় বা খনির মতো স্থান থেকে নিয়ম না মেনে অতিরিক্ত পরিমাণে বালু ও পাথর উত্তোলন করা বোঝায়। এই প্রক্রিয়াটি প্রায়ই স্থানীয় পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর ফলে ভূমি ক্ষয়, নদীর গভীরতা কমে যাওয়া, পানির প্রবাহে পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি এবং স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। এটি অনেক ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের লঙ্ঘন হিসাবে বিবেচিত।আসলে বালু ও পাথরের অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলন কখন হচ্ছে?

বালু ও পাথরের অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলন সাধারণত তখনই হয়, যখন প্রাকৃতিক সম্পদের চাহিদা বেশি থাকে এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির নজরদারি কম থাকে। বিশেষ করে বড় নির্মাণ প্রকল্প, যেমন রাস্তা, সেতু, এবং শহরের অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শুরু হলে বালু ও পাথরের চাহিদা বেড়ে যায়, যা অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলনের প্রবণতা বাড়ায়। এ ধরনের উত্তোলন রাতের বেলায় বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘটে, যেখানে প্রশাসনের নজরদারি তুলনামূলকভাবে কম থাকে। এছাড়া বর্ষাকালে নদীগুলির পানি বাড়লে ও প্রবাহ বৃদ্ধি পেলে এই কাজগুলো আরো সহজে ও দ্রুততর করা সম্ভব হয়।
বালু ও পাথরের অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলনে কারা জড়িত?
বালু ও পাথরের অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলনে বেশ কয়েকটি পক্ষ জড়িত থাকে। সাধারণত, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা, ঠিকাদার, অবৈধ খনি মালিক, মধ্যস্বত্বভোগী এবং শ্রমিকরা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকে। অনেক সময় রাজনৈতিক নেতা বা ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরাও এর সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত থাকতে পারেন, কারণ তাদের সহযোগিতা ছাড়া এই অবৈধ উত্তোলন চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়াও কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যেরও সহযোগিতা থাকে, যারা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে সুবিধার বিনিময়ে এ ধরনের কার্যক্রমে সমর্থন দেন।প্রশ্ন হলো বালু ও পাথরের অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলনে দেশের কি ক্ষতি হচ্ছে আমরা কি তা জানি?

বাংলাদেশে বালু ও পাথরের অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলনের ফলে বহু ধরনের ক্ষতি হচ্ছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক্ষতিগুলি যেগুলো আমরা দেখতে পাই-নদীভাঙন ও ভূমি ক্ষয়।অতিরিক্ত বালু ও পাথর উত্তোলনের কারণে নদীর তীর ভাঙে এবং নদীর গভীরতা পরিবর্তিত হয়। ফলে আশপাশের এলাকা ভূমি ক্ষয়ের ঝুঁকিতে পড়ে।এবং পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা।বালু ও পাথর উত্তোলনের ফলে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষ করে নদী অঞ্চলের মাছ, জলজ উদ্ভিদ, ও অন্যান্য জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাবও বিশেষ পড়ছে। এমনকি নদী ও জলাশয় থেকে অতিরিক্ত বালু উত্তোলনের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস পাচ্ছে, যা কৃষি ও পানীয় জলের সংকট সৃষ্টি করছে।নদীভাঙন ও ভূমি ক্ষয়ের কারণে কৃষি জমি হারিয়ে যাচ্ছে, যা কৃষকদের আয়ের উৎসকে সংকটে ফেলে এবং গ্রামের অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ছে।

নদী ও খাল থেকে অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলনের ফলে সেতু, রাস্তাঘাট, এবং বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের অবকাঠামোকে দুর্বল করে দেয় যার কারণে ইনফ্রাস্ট্রাকচারেরও ক্ষতি হয়।

আমাদের সকলেই জানা, বালু উত্তোলনের ফলে নদীর তলদেশ নীচে নেমে যাওয়ায় বন্যার সময় পানি দ্রুত জমে যায় এবং বন্যার মাত্রা বাড়িয়ে তোলে।এই অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলন অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশে পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা আরো বাড়তে পারে ধারণা করা যায়, যা দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি।

প্রশ্ন আশা স্বাভাবিক,বালু ও পাথরের অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলনে যারা জড়িত তারা কিভাবে উপকারী হচ্ছে? উত্তর হতে পারে, বালু ও পাথরের অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলনে যারা জড়িত, তারা কিছু উপকারীতা উপভোগ করতে পারে, যেমন:বালু ও পাথরের উত্তোলন থেকে তারা অর্থ উপার্জন করতে পারে। তবে, অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলনের ফলে পরিবেশগত সমস্যা, ভূমি ধ্বংস এবং সামাজিক সংকট সৃষ্টি হয়,তাই, একটি সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন।

বালু ও পাথরের অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলন যারা করছে তারা প্রায়শই নিজেদের এবং ভবিষ্যতের জন্য একাধিক হুমকির মুখোমুখি হচ্ছে। তাদের অজান্তেই এসব কার্যক্রম দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হুমকি পরিলক্ষিত হচ্ছে -প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষতি।অবাধ উত্তোলনের ফলে বালু এবং পাথরের মজুদ কমে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ হিসেবে সংকট সৃষ্টি করবে। এর ফলে নির্মাণ খাতে খরচ বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে।

ইতিমধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে, পরিবেশের অস্থিরতা।অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলন পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করছে,যা মাটির গুণমান, জলবায়ু এবং স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। পরিবেশের এই পরিবর্তন মানুষের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।এছাড়া নদী ও খাল থেকে বালু উত্তোলনের কারণে পানি প্রবাহের পরিবর্তন ঘটেছে, যা বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।ফলে স্থানীয় জনগণের জীবন এবং সম্পত্তি এতে বিপদে পড়ছে।অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, কৃষি জমি হারানোর ফলে খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে, যা ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। একইভাবে, নির্মাণ শিল্পের অব্যবহৃত স্থানে কাজ করার সুযোগও অনেক সীমিত হবে।এমনকি স্থানান্তর, এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করছে। এভাবে সামগ্রিকভাবে সমাজের স্থায়িত্বের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

অবৈধ উত্তোলনের ফলে উৎপন্ন ধুলাবালি এবং অন্যান্য দূষিত পদার্থ স্থানীয় জনগণের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হচ্ছে।যা দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন শ্বাসকষ্ট, এলার্জি ইত্যাদি দেখা দিচ্ছে।
এভাবে, বালু ও পাথরের অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলন কেবল অল্প সময়ের জন্য আর্থিক সুবিধা দিলেও, তা।মানব সমাজ ও পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক ও স্থায়ী ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে

তাহলে নিশ্চয়ই ভাবা উচিত, বালু ও পাথরের অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলনে যারা জড়িয়ে আছে তাদের কিভাবে আইনের আওতায় আনা যায়?

বালু ও পাথরের অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলনে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রয়োজনীয় আইন এবং নীতিমালা তৈরি করতে হবে যা বালু ও পাথরের উত্তোলনকে নিয়ন্ত্রণ করে। এর মধ্যে লাইসেন্স প্রদান, পরিবেশগত মূল্যায়ন, এবং নিয়মিত পরিদর্শনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

পরিদর্শন ও মনিটরিং -এ বিশেষ কমিটি বা সংস্থা গঠন করা উচিত এবং নিয়মিতভাবে উত্তোলনস্থল পরিদর্শন করবে এবং অনিয়মিত কার্যক্রম চিহ্নিত করবে।স্থানীয় জনগণকে আইন ও এর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। তাদেরকে অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানানো যেতে পারে। এবং যারা আইন লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার, যেমন জরিমানা বা কারাদণ্ড। বলা যায় এটি কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে।

স্থানীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদেরকে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা উচিত। তারা অভিযোগ জানাতে এবং উত্তোলন কার্যক্রমের তদারকি করতে পারে।এবং পরিবেশ রক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং এনজিওকেও যুক্ত করা যেতে পারে।আবার উত্তোলন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি (যেমন, ড্রোন বা স্যাটেলাইট) ব্যবহার করা যেতে পারে। বলা যায় এই পদক্ষেপগুলি কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে, বালু ও পাথরের অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলন অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।

  • বলুন তো বালু ও পাথরের অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলন বন্ধে আমাদের বাংলাদেশী সাধারণ জনগণ ও কতৃপক্ষের করনীয় কি হতে পারে?

বালু ও পাথরের অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলন বন্ধে সাধারণ জনগণ ও কর্তৃপক্ষের করণীয় হতে পারে -সাধারণ জনগণের করণীয়:
1.পরিবেশ ও সামাজিক ক্ষতির ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

2 .অনিয়মিত উত্তোলন চিহ্নিত করে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ জানানো।

3.স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্পে অংশগ্রহণ এবং আইনের প্রতি সহায়তা করা।

    কর্তৃপক্ষের করণীয় হতে পারে –

    • নিয়মনীতি ও আইন প্রণয়নও কার্যকর আইন ও নীতিমালা তৈরি করা।
    • পরিদর্শন ও মনিটরিং ও নিয়মিত পরিদর্শন ও তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করা।
      3.আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা।
    • জনসচেতনতা কার্যক্রম হতে পারে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কর্মশালা ও সেমিনার আয়োজন করা।

    মোকাবিলার জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও পরিমাণ নির্ধারণ, যারা অনুমোদন ছাড়াই উত্তোলন করছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা,উত্তোলনের পরপরই সেই স্থান পুনর্বনায়ন বা পরিবেশ পুনর্গঠনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, যাতে পরিবেশ দ্রুত তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারে।
    আাশা করা যায় এভাবে, জনগণ ও কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে কাজ করলে অনিয়ন্ত্রিত উত্তোলন কমানো সম্ভব হবে এবং সৃষ্ট স্থায়ী ক্ষতি অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হবে।

    About somoyer kagoj

    Check Also

    বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওয়ানডে দল ঘোষণা

    স্পোর্টস ডেস্ক: বাংলাদেশের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের জন্য ১৫ সদস্যের দল ঘোষণা করেছে ওয়েস্ট …

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *