Tuesday , January 14 2025

ভুল বলে কিছু নেই সবই শিক্ষা

ড. কামরুজ্জামান:
শিক্ষক, কলামিস্ট ও গবেষক

ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ” To Err is Human “। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। মানুষের কাজ হচ্ছে ভুল করা। ভালো মানুষ ভুল বেশি করে। ভুলে ভরা এই পৃথিবীতে শুদ্ধ করতে গিয়ে মানুষের ভুল সবচেয়ে বেশি হয়। মানুষ পৃথিবীতে নানারকম কাজ করে। মানুষ যখন কাজ করে তখন মনে করে সে কাজটি সঠিকই করছে। কিন্তু ফলাফল জানার পর ধরা পরে কাজটি সঠিক হয়েছে না ভুল হয়েছে। কাজটি সঠিক হলে কথা নেই। কিন্তু যদি ভুল হয় তাহলে সংশোধন বা ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। ভুল করার মাধ্যমেই শিক্ষা লাভ হয়।

পৃথিবীতে বহু বিখ্যাত মানুষ রয়েছেন যারা ভুল করে করে শিখেছেন। তাদের যদি ভুল না হতো তাহলে হয়তো তারা জগৎবিখ্যাত হতে পারতেন না।

তবে মানুষের কিছু ভুল আছে ক্ষমার অযোগ্য। এগুলোকে ভুল বলা যাবে না। বলতে হবে অপরাধ। অপরাধ আর ভুল এক জিনিস নয়। তবে মানুষ ভুলেও অপরাধ করে। আবার না বুঝেও ভুল করে। যেমন: অনেক মানুষ না বুঝে অতি আবেগে অভিমান করে রাগ করে আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যা মহাপাপ। আর এটি এমন একটি কাজ এই কাজ থেকে কখনো শিক্ষা লাভ করা যায় না। আবার মানুষকে মেরে ফেলা। এই জাতীয় কাজ অত্যন্ত ঘৃণিত এবং নিন্দিত কাজ। এই কাজ থেকে শিক্ষা লাভ হয় না। এই রকম অপরাধমূলক কাজ থেকে অন্য মানুষ শিক্ষা লাভ করতে পারে। কিন্তু যিনি এই জাতীয় ভুল করেন তার পক্ষেও সংশোধন হওয়ার সুযোগ থাকে না।

মানুষ সামাজিক জীব। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নানা রকমের কাজের সাথে সম্পৃক্ত হয়। সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নেতৃত্ব দিতে হয়। দিতে হয় অনেক সিদ্ধান্ত। এইসব কাজ ও সিদ্ধান্ত কারো পক্ষে যায় আবার যায় কারো বিপক্ষে। স্বার্থ যেখানে বড় হয়ে দেখা দেয় ভালো কাজও সেখানে মূল্যহীন হয়ে থাকে।

একজন মানুষ সবচেয়ে বেশি শিক্ষা অর্জন করে তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে। তার পাশের পরিবেশ থেকে। মানুষ ভুল কোথায় করে? মানুষ কথায় ভুল করে, কাজে ভুল করে, চলায় ভুল করে এবং মানুষ মানুষকে চিনতে ভুল করে। ভুল হওয়া মানেই অভিজ্ঞতা অর্জন করা। আর এই অভিজ্ঞতাই তাকে নতুন করে শিখায়। বুদ্ধিমান মানুষ ভুল করলে সতর্ক হয়। পরের বার যাতে ভুল না হয় সেজন্য সচেতন হয়ে কাজ করে। এই সচেতনতা অর্জন করাই হচ্ছে বড় শিক্ষা।

মানুষ ভুল করবে এটাই স্বাভাবিক। ব্যার্থ হবে কখনও কখনও। কবি বলেছেন, “একবার না পারিলে দেখ শতবার।” এর মানে হচ্ছে, চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ভুল হলেও থেমে যাওয়া যাবে না। ভুল হলে কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করতে হবে। ভেঙে পড়া যাবে না। ভুল কাটিয়ে উঠার উপায় খুঁজে বের করতে হবে।

অনেক সময় কাজ করতে গেলে বা কথা বলতে গেলে ভুল হয়ে যায়। কিন্তু দ্বিধা দ্বন্দ্ব না করে ভুল হয়েছে এটা বুঝতে পারা জরুরি। এতে করে শুধরে নেয়া যায়। ভুল হয়েছে এটা যত তারাতাড়ি বুঝা যায় তত তারাতাড়ি সংশোধন করে নেওয়া যায়। বুদ্ধিমানরা তাই করে। আরও একটি বিষয় হচ্ছে ভুল হয়ে গেলে কাজের ধরন পরিবর্তন করতে হয়। পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আশ্চর্যজনক ঘটনাও ঘটে যায়। ভুল করার মাধ্যমে এমন কিছু সৃষ্টি হয় যা মানব কল্যাণে দারুণ কাজ করে। ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিস্কার করেছিলেন ভুল করেই। এই রকম অজস্র উদাহরণ আছে পৃথিবীতে।

বিনয় এবং প্রকৃত শিক্ষার পরিচয় হচ্ছে ভুল স্বীকার করতে পারার সাহসিকতা অর্জন করা। মানুষ সাধারণত নিজের ভুল স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু উচিত হচ্ছে- ভুল স্বীকার করে নিজেকে শোধরাবার। মানুষ ভুল করে যেমন শিখে তেমনি ঠেকলেও শিখে। মানুষ আসলে বুঝতে পারার পর থেকে মৃত্যু অবধি শিখতেই থাকে। কিছু কিছু সময় এমন পরিস্থিতির উদ্রেক হয় মানুষ শিখতে বাধ্য হয়। এই শিক্ষা আসলে অভিজ্ঞতা অর্জন। যা পাঠ্য বইয়ে খোঁজে পাওয়া যায় না।

আমাদের মানুষের একটা স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভুল নিয়ে অনুশোচনা করা। কিন্তু জীবনে এগিয়ে যেতে হলে ভুলের জন্য অনুশোচনা করা উচিত নয়। বরং ভুলের জন্য শিক্ষা নিয়ে সামনে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। অনুশোচনা মানুষকে ভিতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। তখন আর ভালো কোনো চিন্তা মাথায় আসে না। হতাশা ভীড় করে শরীর ও মনে। মানুষ সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। তাই ভুলের জন্য অনুশোচনা করা উচিত নয়। বরং প্রতিটি ভুল থেকে যে অভিজ্ঞতা হয় এটাকে শিক্ষা হিসাবে নিয়ে জীবনে কাজে লাগাতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে।

ইতিবাচক চিন্তা মানুষকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যায়।অনেক সময় কাজ করতে গিয়ে ভুল হয় যায়, কথা বলতে গিয়ে ভুল হয়ে যায়, এটাকে ভুল হিসাবেই চিন্তা করা উচিত। এই ভুলে জন্য ভেঙে পড়া যাবে না। কাজ করতে গিয়ে ভুল হয়ে গেছে তখন এটাকে নেতিবাচকভাবে না নিয়ে সাধারণতভাবে নেওয়া উচিত। ইতিবাচক মনোভাব রেখে এর পরে যাতে ভুল না হয় তার জন্য সচেতন থাকা প্রয়োজন। নিজের মধ্যে যেমন ইতিবাচক চিন্তা রাখতে হবে তেমনি দেখার দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক করতে হবে। তাহলেই হয়তো ভুল থেকে সঠিক শিক্ষা অর্জিত হবে।

ভুলের জন্য অন্য কাউকে দোষারোপ না করা উচিত নয়। আমাদের একটা মজ্জাগত সমস্যা হচ্ছে নিজে ভুল করলেও ভুল হয়েছে স্বীকার করতে চাই না। এমনকি অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। এটা একদিকে যেমন অন্যায় অন্য দিকে নিজেকে বঞ্চিত করা হয় প্রকৃত শিক্ষা লাভ থেকে। একজন ভালো মানুষ নিজের দ্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে যেমন সচেতন থাকে তেমনি ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলে সংশোধন করে নেয়। অন্যকে দায়ী করে না, অন্যকে বিপদে ফেলে না। শিক্ষার কাজ শুভ জ্ঞান অর্জন নয়, প্রকৃত শিক্ষা মানবিকতা শেখায়। ভুল সংশোধনের মাধ্যমে শিক্ষা লাভ যেমন হয় তেমনি মানবিকতারও বিস্তার ঘটে।

আমরা ভুল হয়ে গেলে হতাশ হয়ে পড়ি। সবই বুঝি গেলো। কিন্তু ভুলের ভিতরে যে আত্মোপলব্ধিও থাকে সেটা বুঝতে পারি না। তবে যারা বুদ্ধিমান তাদের আত্মোপলব্ধি ঘটে। তারা ভুল হয়ে গেলেও ভুল বুঝতে পেরে আবার শুরু করে। এতে মনে যেমন প্রশান্তি বাড়ে কাজেও আসে গতি। অনেক সময় কোনো কাজ বার বার করেও সফল না হওয়ার বহু নজির বহু আছে। কিন্তু এই রকম নজিরও আছে দীর্ঘ সময় পরে বহু চেষ্টা ও সাধনার পরে সফল হতে। আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন, “যে কখনো ভুল করেনি সে কখনো নতুন কিছু চেষ্টাই করেনি।” ভুল মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটায়। মানুষ আসলে ব্যর্থতা থেকেই শিখে, সফলতা থেকে নয়।

প্রতিটি মানুষের জীবনে সেরা শিক্ষাটা আসে সবচেয়ে বড় ভুল থেকে এটাই সত্যি। ভুল কাজ, ভুল সিদ্ধান্ত মানুষকে দক্ষ করে তোলে। ভুল মানুষের অভিজ্ঞতা বাড়ায়, আর অভিজ্ঞতা মানুষের ভুল কমায়। একজন গবেষকের কাছে ভুল হলো আবিষ্কারের প্রবেশপথ। মানুষ ভুল করবে এটাই স্বাভাবিক। আর প্রতিটি ভুল থেকে কোনো না কোনো শিক্ষা অর্জিত হবেই। তাই ভুল বলে কিছু নেই, সবই আসলে শিক্ষা।

About somoyer kagoj

Check Also

নিত্য পণ্যের দাম মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখা প্রয়োজন

ড. কামরুজ্জামান:শিক্ষক, কলামিস্ট ও গবেষকবর্তমানে বাজারে সকল ধরনের নিত্য পণ্যের দাম যে কোনো সময়ের চেয়ে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *