কুষ্টিয়া প্রতিনিধি:
কুষ্টিয়া জেলা শহর সংলগ্ন জুগিয়া বালুরঘাট। দীর্ঘদিন ধরে এই বালুরঘাট থেকে বালু উত্তোলন বন্ধে মানববন্ধন করাসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে এলাকাবাসীরা। দিন শেষে ফলাফল শুন্য। ক্ষমতাশালী বালু খেকোদের কাছে জনগণ একেবারেই মূল্যহীন। স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের ছত্রছায়ায় অবাধে নদী থেকে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করেছে বালু খেকো প্রভাবশালী মহল।
৫ আগষ্ট ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে গত ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত বালুমহালটি বন্ধ ছিল। এসময়ের মধ্যে বালু খেকো আওয়ামী লীগের দোসর স্থানীয় সদস্য সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর মহিদুল ইসলাম ও তার সহযোগীরা ভোল পাল্টানো শুরু করেছে। তারা স্থানীয় বিএনপি নেতাদের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ম্যানেজ করে পুনরায় বালু উত্তোলন করার পায়তারা শুরু করে। একপর্যায়ে সফলও হন তারা।
গতকাল মঙ্গলবার ভোর থেকে শুরু হয় বালু উত্তোলন। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর নদী তীরে গিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে এলাকাবাসীরা। একপর্যায়ে এলাকাবাসীরা কুষ্টিয়া-ঈশ্বরদী মহাসড়কের কানাবিল মোড়ে অবস্থান নেয়। তারা ব্যারিকেড দিয়ে মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। সেসময় মহাসড়কের উপরে আগুন জ্বালিয়ে বিভিন্ন শ্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করেন এলাকাবাসীরা। পরবর্তীতে কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। বিক্ষোভকারীদের দাবির সাথে একমত পোষণ করে এবং প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়ে মহাসড়ক যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয় পুলিশ।
বিক্ষোভকারীদের একাংশ প্রতিবেদককে জানান, ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় স্বৈরশাসক, গণহত্যাকারী খুনি হাসিনার। আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া এই দ্বিতীয় স্বাধীনতা ভূলুন্ঠিত করতে ফাঁদ পেতেছে স্বৈরশাসকের দোসররা। তাদের পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছে বিএনপির অঙ্গসংগঠনের কিছু নেতা-কর্মীরা। আওয়ামীলীগের দোসরদের দিয়ে চালানো হচ্ছে বালুমহাল। যৎসামান্য টাকার জন্য আওয়ামী লীগের সিন্ডিকেটের কাছে বিক্রি হয়েছে অনেকেই। এ যেন পুরানো বোতলে নতুন মদের মতো।
তারা আরো জানান, দীর্ঘদিন ধরে কুষ্টিয়ার জুগিয়া বালুমহালটি সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুবউল আলম হানিফ ও তার চাচাতো ভাই সাবেক সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতার আশির্বাদপুষ্ট ১৫ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর (সদ্য সাবেক) মহিদুল ইসলাম দখলে রেখে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ঘোড়ার গাড়োয়ান থেকে হয়েছে কোটিপতি। নিজেতো নিয়েছেই এমনকি হানিফ-আতাকে মোটা অংকের টাকার ভাগ দিয়েছে। এখন শুধু হানিফ-আতার জায়গায় বসানো হয়েছে কয়েকজন বিএনপি নেতাকে। তবে দুধের সর খাচ্ছে সেই আওয়ামীলীগের দোসররাই। এলাকায় ছড়ানো হচ্ছে আওয়ামীলীগের মতো বিএনপিও লুটপাট করে খাওয়া শুরু করেছে। এতে বিএনপির বদনাম ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র।
এলাকাবাসীরা জানান, এই বালুমহালের কারনে এলাকায় পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। নানা ধরনের রোগ বালাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে রাস্তাঘাট। বড় বড় ড্রাম ট্রাকে করে টানা হচ্ছে বালু। এতে একমাসও রাস্তা টিকছে না। সাধারণ মানুষ রাস্তা দিয়ে ঠিকভাবে চলাচল করতে পারছে না। এছাড়া নদী তীরবর্তী ঘর-বাড়িগুলো নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এই বালুমহাল বন্ধের জন্য লিখিতভাবে জেলা প্রশাসককে অভিযোগ দিয়েও কোন লাভ হয়নি। বাধ্য হয়ে মহাসড়ক অবরোধ করে অবস্থান নিয়েছেন তারা। স্থানীয় সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর মহিদুল, ১৫ নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি আমিরুল ইসলাম, ডালিম, সেলিম, আসলাম, তরিকুল, বাবুসহ তাদের সহযোগীরা বালু উত্তোলন করে নিজেদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে গিয়ে জনসাধারণের জীবন হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এই বালুমহাল বন্ধসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন তারা।
সুত্রে জানা যায়, গত ৪ ফেব্রুয়ারি পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে মেসার্স মেহেদী এন্টারপ্রাইজ’র প্রোপাইটার মহিদুল ইসলাম গড়াই নদীর ড্রেজিং ও তীর সংরক্ষণ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ড্রেজিং হতে প্রাপ্ত স্তুপাকার বালির ডাউক নম্বর ১ জুগিয়া মৌজা এবং ডাউক নম্বর ২ গোপিনাথপুর মৌজার ড্রেজিংকৃত নির্দিষ্ট চিহ্নিত স্থানে স্তুপাকারে রাখা বালু অপসারণ কার্যাদেশ পান। ১৩ এপ্রিল ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বালু অপসারণ কাজের সময়সীমা নির্ধারণ রয়েছে। কার্যাদেশের ৫ নম্বর শর্তে উল্লেখ আছে পরিবহন করার সময় পাওবোর বাঁধ অথবা রাস্তাঘাটের ক্ষতি হলে নিয়োজিত ঠিকাদারকে নিজ খরচে সেটি মেরামত করতে হবে। ৬ নং শর্তে উল্লেখ আছে দুর্ঘটনায় এড়ানোর জন্য বালু পরিবহন করার সময় গাড়ির গতি সীমিত রাখতে হবে। ৭ নং শর্তে উল্লেখ রয়েছে হাইওয়ে এবং লোকাল রাস্তায় ট্রাক বালুবাহী পরিবহন চলাচলের সময় সরকারি বিধি বিধান মেনে বালু অপসারণ করতে হবে। ৮ নং শর্তে উল্লেখ আছে বালু পরিবহনে কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে দায় দায়িত্ব বহন করতে হবে।
বিক্ষোভরত এলাকাবাসীদের বরাত দিয়ে আরো জানা যায়, পূর্বের স্বৈরাশাসক হাসিনার দোসররা আবারো বিএনপির কিছু সুবিধাবাদী নেতাকর্মীদের হাত করে এই বালুমহাল চালানোর পাঁয়তারা করছে। ৫ আগস্টের পর থেকে এই বালুমহাল বন্ধ হলে এলাকার মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। তবে আবারো এই বালুমহাল চালু হলে বিএনপির উপর থেকেও মানুষের আস্থা হারিয়ে যাবে। বালি তোলার ঘটনায় এলাকায় যেকোন সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হতে পারে।
এবিষয়ে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক কাউন্সিলর মহিদুল ইসলাম সহ উপরে উল্লেখিত অভিযুক্তদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তাদের অধিকাংশের ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কুতুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিএনপি বা অঙ্গ সংগঠনের কেউ যদি এধরনের কোন কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান, ঘটনাস্থলে আমাদের সার্কেল এসপি ও সদর থানার ওসি ছিলেন। আপাতত জনগনের যে দাবী ছিলো ট্রাক দিয়ে রাস্তা ক্ষতি করছে সে গুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যিনি এই ঘাট ইজারা নিয়েছে তিনি মনে হয় এলাকায় নেই। কারা বালি তুলছে সেটা নিশ্চিত হওয়া দরকার। এগুলো ফায়সালা হবার পর সরকারী নিয়মে কেউ যদি ইজারা নিয়ে থাকে তাহলে তারা তুলবে।
সংশ্লিষ্ট প্রসঙ্গে কুষ্টিয়ার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক শারমিন আক্তার বলেন, “বালুমহাল ইজারা দেওয়ার ক্ষমতা সরকারের। জেলা প্রশাসক সরকারের পক্ষ থেকে ইজারা দেয়। বিধি মোতাবেক কাউকে ইজারা দেওয়া হলে সে যদি আবার অন্য কাউকে দেয় তবে তা ইজারার বিধি সম্মত নয়। এটা আমরা অ্যালাউ করি না। এমন হয়ে থাকলে ইজারার শর্ত ভঙ্গের যে বিষয় আছে সেটা বিবেচনা করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিবো।
তিনি আরো জানান, যদি ওই বালুমহাল ইজারার আওতায় থাকে তাহলে স্থানীয়দের দাবি বিবেচনা করে ইজারা বাতিল করা বা বালুমহাল বিলুপ্তির আইনানুগ যে ব্যবস্থা সেটা নিবো। আর যদি ইজারা দেওয়া না থাকে তবে যারা বালু তুলছে তারা অবৈধ। অবৈধ কোন ব্যক্তি বালু তুললে সে যেই হোক তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে আমাদের কোনো প্রশ্রয় থাকবে না।