Tuesday , January 14 2025

নিত্য পণ্যের দাম মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখা প্রয়োজন

ড. কামরুজ্জামান:
শিক্ষক, কলামিস্ট ও গবেষক
বর্তমানে বাজারে সকল ধরনের নিত্য পণ্যের দাম যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। সাধারণ মানুষ বাজারে গিয়ে অস্বস্তি বোধ করে। চাল-ডাল লবন পিঁয়াজ মরিচ আদা রসুন তেল শাকসবজিসহ সকল পণ্যের দাম আকাশচুম্বী। দরিদ্র মানুষ, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ তাদের আয় দিয়ে ২০ দিনও ভালো করে চলতে পারে না। নিত্য পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের চলতে কষ্ট হচ্ছে। কাটছাঁট করেও হিমসিম খাচ্ছে।

বাজারে গেলেই মানুষের অসহায় দৃষ্টি চোখে পড়ে। যে লাউ ৬০ টাকা দিয়ে কেনা যেতো তার দাম ১৫০ টাকা। যে মিষ্টি কুমড়া ৪০ টাকা কেজি কেনা যেতো তার দাম ৭০ টাকা। বাজারের সবচেয়ে সস্তা সবজি হিসাবে পরিচিত পেঁপে, দাম দ্বিগুণ বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা কেজি দরে। চিচিঙ্গা ১০০ টাকা কেজি, বেগুন ১২০ টাকা কেজি, করলা ১০০ টাকা, ধুন্দল ১০০ টাকা, লেবু ৩০ টাকা হালি, ডিম ৪২০ টাকা ট্রে, শশা হাইব্রিড ৭০ টাকা, টমেটো ২৮০ টাকা কেজি, বরবটি ১৪০ টাকা কেজি, পিঁয়াজ ১২০ টাকা কেজি, রসুন ২৪০ টাকা কেজি, আলু ৭০ টাকা কেজি, আদা ২৮০ টাকা, মাছ কেজি প্রতি ২০০ টাকা থেকে শুরু করে হাজার টাকা পর্যন্ত মূল্য, বয়লার মুরগী ১৯০ টাকা কেজি। ইলিশ মাছের কথা বাদ দিলাম। এই মাছ এখন ধনীদের খাবার। প্রতিদিনই বাড়ছে নিত্য পণ্যের দাম। দেখার যেন কেউ নেই।

সাধারণ মানুষের আসলে কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না। বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীরা একরকম কথা বলে আবার আড়তদাররা বলে আরেকরকম। ক্রেতাদের কথা শোনার কেউ নেই। কেন বাড়ছে প্রতিনিয়ত নিত্য পণ্যের দাম তার সদুত্তর পাওয়াও যাচ্ছে না। তবে বিভিন্ন মাধ্যম ও বাজার বিশ্লেষণ করে যেটা মনে হয় তা হলো – যতটা না পণ্যের দাম বাড়ছে যোগানের অভাবে তারচেয়ে বেশি বাড়ছে মজুদ এবং সিন্ডিকেটের কারণে। এভাবে বাজার চললে মানুষের কষ্ট আরও বেড়ে যাবে। মানুষ আর্থিক সমস্যাসহ মানসিক স্বাস্থ্যহীনতার মধ্যে পড়ে যাবে।

নিত্য পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কিছু কারণ হচ্ছে- সাম্প্রতিক সময়ে সংগঠিত হয়ে যাওয়া বন্যা। সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল ভয়াবহ বন্যায় কবলিত হয়। প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ বন্যার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নোয়াখালী, ফেনী কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়িসহ প্রায় ১২ টি জেলার নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোনো কোনো এলাকা ১২ থেকে ১৮ ফুট পর্যন্ত পানির নিচে চলে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঘরবাড়ি, কৃষি জমি, মাঠের ফসল ও গবাদিপশু। ভয়াবহ এই বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষি ফসল। যার প্রভাব এখন নিত্য পণ্যের বাজারে দেখা মিলছে বলে অনেকেই মনে করেন।

এছাড়াও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর ও নেত্রকোনা জেলা এখনও বন্যা কবলিত। এই সব অঞ্চলের কৃষি জমির ফসল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রভাব সরাসরি কাঁচাবাজার ও শাকসবজিসহ নিত্য পণ্যের উপর পড়ছে। কিন্তু এটাও আমাদের ভাবতে হবে যে পরিমাণে দাম বাড়ছে তার সাথে বন্যার সম্পর্ক কতটুকু!

শাকসবজি ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সারা বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। আমাদের দেশ কৃষি প্রদান দেশ। তরিতরকারি ও শাকসবজি বেশি উৎপাদিত হয় বাসাবাড়ির আঙ্গিনায় ও আশপাশের উচু জমিতে। রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের কয়েকটি জেলায় কিছুটা কম উৎপাদন হলেও বাকী সব জেলায় শাকসবজি ও তরিতরকারি উৎপাদন হয় ব্যাপকভাবে। মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে উৎপাদন করে। আবার অনেকেই বানিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদন করে। আমাদের দেশে ঢাকার সাভার এবং উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে এখন বানিজ্যিক ভিত্তিক শাকসবজি ও তরিতরকারি উৎপাদন করা হচ্ছে। সে হিসাব করলে নিত্য পণ্যের দাম খুব বেশি বাড়ার কথা নয়। অনেকেরই ধারণা বাজার সিন্ডিকেট মূল্য বৃদ্ধির জন্য দায়ী।

আমাদের দেশে যে কোনো পণ্য বাজারে আসার আগে মধ্যস্বত্বভোগীর দখলে আসে। এই মধ্যস্বত্বভোগী বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এরা কৃষকের কাজ থেকে অল্প মূল্যে পণ্য ক্রয় করে তিনগুণ চারগুণ বেশি দামে বিক্রয় করে থাকে। এদের সিন্ডিকেট অত্যন্ত শক্তিশালী। এদের সাথে আবার জড়িত থাকে সমাজের কিছু অসৎ মানুষ। এই সিন্ডিকেট দেশী পণ্য যেমন নিয়ন্ত্রণ করে তেমনি আমদানিকৃত পণ্যও নিয়ন্ত্রণ করে। আর এ কারণে তেলসহ আমদানি পণ্যেরও বাজার মূল্যও বর্তমানে কিছুটা বেশি।

নিত্য পণ্যেের দাম নিয়ে বরাবরই সাধারণ মানুষের অভিযোগ থাকে। এটা অনেকদিন থেকেই দেখছি। তবে বর্তমান বাজারদর অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে অনেকটাই বেশি।

গত ৫ আগষ্ট আওয়ামীলীগ সরকার পদত্যাগ করার পর ৯ আগষ্ট ২০২৪ ইং তারিখ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেয়। সংগত কারণেই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা নিত্য পণ্যসহ সকল ধরনের ব্যাবহার্য জিনিসপত্রের দাম মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকবে। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে – নিত্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে অতিরিক্ত ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে মানুষের আয় তত কমে যাচ্ছে, মানুষ ঋণের ঝুঁকিতে পরে যাচ্ছে।

যারা নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ এবং সৎ রোজগার করে জীবনযাপন করে তাদের বাড়তি যে কোনো ব্যয় বহন করা কষ্টসাধ্য হয়ে পরে। গত পাঁচ বছর ধরে চাকুরীজীবি যাদের বেতন এক টাকাও বাড়েনি তাদের অবস্থা আরও খারাপ। ছোটখাটো আয়ের মানুষ ও ছোট ব্যবসায়ী তাদের অবস্থাও ভালো না। নিম্ন আয়ের মানুষ, দৈনিক মজুরি ভিত্তিক শ্রমিকশ্রেণি মানুষ তারাও ভালো নেই। এই মানুষগুলো খুব দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখায়, দেখাতে বাধ্য হয়। বাস্তবতা তাদের বাধ্য করে।

আমাদের দেশে নিত্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির আরও একটি কারণ হচ্ছে – বাজারে দাম বাড়বে এই অজুহাতে একসাথে সবাই পণ্য কেনার জন্য উঠেপড়ে লাগে। এর ফলে বাড়তি পণ্যের চাহিদা বাড়ে। এই ফাঁকে ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত দামে পণ্য বিক্রি করে। এটা কখনও কখনও গুজবে হয় আবার ব্যবসায়ীরাও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে থাকে। এই ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট একটা দুইটা পণ্যকে বেছে নেওয়া হয়। যেমন: বর্তমানে প্রায় সব পণ্যের দাম বাড়লেও ডিম আর কাঁচামরিচের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক। কাঁচামরিচ কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৪৬০ টাকা করে। আর ডিম ট্রে ৪২০ টাকা।

বর্তমান পরিস্থিতিতে নিত্য পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা খুব বেশি প্রয়োজন। আর এর জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

বাইরে থেকে আমদানিকৃত পণ্য মজুদ না করে সরাসরি বাজারে ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তেল পেঁয়াজ রসুন আদা আটা চাল আমদানি পরিমাণে একটু বাড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে নতুন বাজার খুজতে হবে।

সরকার নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রি নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাজার মনিটরিং বাড়াতে হবে। বেশি দামে যারা পণ্য বিক্রি করবে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য টিসিবি পণ্য বিক্রি বাড়াতে হবে। সরকার কর্তৃক ভর্তুকি দিয়ে কম মূল্যে পণ্য বিক্রিতে প্রকৃত প্রাপ্যদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

মধ্যস্বত্বভোগী ও সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। কৃষক যাতে পণ্যের ন্যায্য মূল্য পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। কম মূল্যে এবং নির্ধারিত মূল্যে ভোক্তা যাতে পণ্য ক্রয় করতে পারে তাও নিশ্চিত করতে হবে। আড়তদার এবং মজুদদার পণ্য মজুদ করে রাখলে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমরা বিভিন্ন মিডিয়ার খবরে প্রায়ই দেখি কাঁচামরিচ, পিঁয়াজ, আলু ইত্যাদি পণ্য মজুদ করে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করতে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে হাজার হাজার মন পণ্য মজুদের খবর পাওয়া যায়। এগুলো দুঃখ জনক। এদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

সরকারের উচিত হবে বিশেষ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিত্য পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং মনিটরিং করা। বিশেষ করে চাল ডাল আলু তেল পিঁয়াজ মরিচ আদা রসুন, ডিম, বয়লার মুরগী, মাছ ইত্যাদি পণ্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখা। সকল প্রকার শাকসবজি ও তরিতরকারি বাজারজাত করণের ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগী ও সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে কৃষকের ন্যায্য মূল্য পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা এবং সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করা। এ ক্ষেত্রে ভোক্তা অধিকার আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ প্রয়োজন। প্রয়োজন বাজার মনিটরিং এ জনবল কাঠামো বাড়ানো। তবেই হয়তো নিত্য পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

About somoyer kagoj

Check Also

গোপন কার্যকলাপ উন্মোচিত হলে, সিন্ডিকেট কার্যকলাপ বন্ধ হতে বাধ্য

কামরুন নাহার:  সাধারণত সিন্ডিকেট বলতে একদল ব্যবসায়ী বা মধ্যস্বত্বভোগীদের এমন একটি গোষ্ঠীকে বোঝায়, যারা বাজারের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *