Tuesday , January 14 2025

উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হোক গবেষণার জায়গা

ড. কামরুজ্জামান:
শিক্ষক, কলামিস্ট ও গবেষক

আমাদের দেশে বর্তমানে ৫৫ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১০৩ টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মোট ৩৮টি সরকারি ও ৭২টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। এগুলো সবই উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তবে আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষা বলতে বুঝায় বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারং বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নকে। অনার্স মাস্টার্সের একাডেমিক পড়ালেখা মূলত একজন শিক্ষার্থীকে জ্ঞান লাভের প্রাথমিক স্তরকে জাগ্রত করে। এখান থেকে একজন শিক্ষার্থী জ্ঞান লাভের কলাকৌশল শেখে এবং সে অনুযায়ী পরবর্তী জীবন গঠন করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে মূলত গবেষণা লব্ধ পড়ালেখার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করতে হয়। এখানে একাডেমিক পড়ালেখার পাশাপাশি মাঠপর্যায়ের তথ্য ও উপাত্ত ভিত্তিক গবেষণা করতে হয়। একাডেমিক পড়ালেখা শেষে একজন শিক্ষার্থীকে একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে মেধাক্রম অনুযায়ী রিপোর্ট অথবা থিসিস করতে হয়। এই রিপোর্ট অথবা থিসিস করার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীকে উচ্চ শিক্ষা সম্পর্কে রিসার্চ গেইট ওপেন করে দেওয়া হয়। কেউ ইচ্ছে করলে এমফিল পিএইচডি পোস্টডক্টরেট করতে পারে। তাহলে বুঝা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় মূলত গবেষণার জায়গা।

আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ালেখা করে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা। এইচ এস সি পাশ করার পরে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য ভর্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে হয়। তুমুল প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে মেধা তালিকা নিশ্চিত করে তারপর ভর্তির সুযোগ পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী অবশ্যই মেধাবী ছাত্র। কারণ – বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে কোনো স্বজনপ্রীতি নেই, নেই অসৎ উপায় অবলম্বনের সুযোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক সিলেবাসও সেভাবেই প্রণয়ন করা হয় যাতে একজন শিক্ষার্থী নিজেকে তৈরি করে নিতে পারে। এখন কথা হলো- আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার বাইরে আর কি হয়। পড়ালেখার বাইরে একজন শিক্ষার্থী ইচ্ছে করলে অনেককিছুই করতে পারে । বিশ্ববিদ্যালয় মূলত মুক্তচিন্তার জায়গা। জ্ঞান অর্জনের বিশাল চারণভূমি।

আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকরা সরাসরি বড় বড় রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত। তাদের নেতৃত্ব আসে রাজনৈতিক দল থেকে। শিক্ষকদের তেমন নিরপেক্ষ কোনো সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় পদগুলো রাজনৈতিক পরিচয়ে পদায়ন হয়। অনেক সময় মেধাবী শিক্ষক এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গবেষক এবং বিজ্ঞানী থাকেন উপেক্ষিত। শিক্ষকদের মধ্যে চলে লবিং গ্রুপিং। অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় সম্মানিত শিক্ষকদের কেউ কেউ শিক্ষকতা এবং গবেষণা এক পর্যায়ে ছেড়ে দিয়ে দলীয় রাজনীতি এবং কর্মসূচি করেই সময় পার করেন। অনেককেই দেখেছি শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে দিয়ে রাজনীতি করে এমপি মন্ত্রীও হয়ে যেতে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলো ব্যাস্ত থাকে নিজেদের আখের গোছাতে। সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মীরা হল দখল, সিট বানিজ্য ও কমিশন বানিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কখনও কখনও কিছু ছাত্র নেতাদের দোকান বাকী ও ফাও খেতেও দেখা যায়। প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো টুকটাক কিছু দাবীদাওয়া নিয়ে শ্লোগান আন্দোলন করে থাকে।

বিগত সময়ে আমরা দেখেছি ছাত্র নেতা হয়ে যাওয়ার পর তাদের আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। বিশেষ করে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সুযোগ সুবিধা ছিল অফুরন্ত।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে আমাদের দেশের ছাত্র সমাজের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর সাধারণ নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র নেতা ও ছাত্র সমাজের ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল এবং প্রশংসনীয়। ৯০ সালের পূর্ব পর্যন্ত আমাদের ছাত্র সমাজ ও ছাত্র সংগঠন দেশের বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি ও সাধারণ ছাত্রদের অধিকার আদায়ে ভূমিকা রেখেছে উল্লেখ করার মতো। তাদের বেশিভাগ নেতৃত্ব দিয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে ছাত্র রাজনীতি তার আদর্শ এবং নৈতিক মূল্যবোধ হারাতে থাকে। বর্তমান সময়ে এসে ছাত্র রাজনীতি হয়ে যায় অনেকটাই কলুষিত।

এখন কথা হলো আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ছাত্র রাজনীতি কতটা প্রয়োজন? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেইবা রাজনীতি কতটা প্রয়োজন?

উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মুক্তবুদ্ধি চর্চার জন্য ছাত্ররাজনীতি প্রয়োজন আছে। তবে আমাদের দেশে রাজনীতির যে চর্চা হচ্ছে সেটা আদৌ প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। যেখানে আমাদের দেশের রাজনীতি কর্তৃত্ব পরায়ণ, দলীয় লোক না হলে পদ পদবী পাওয়া যায় না, আবার রাজনীতিই করা হয় পদ পদবীর লোভে। এই জাতীয় রাজনীতি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। আরও একটি বিষয় রাজনীতি করার কথা মেধাবীরা। এখন রাজনীতি করে তেলবাজরা। আমাদের দেশে একজন ছাত্র পড়ালেখা করে বিভাগে প্রথম হয়েও অনিশ্চয়তায় থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার। মেধাবী হওয়ার পাশাপাশি দলীয় পরিচয় এবং সাপোর্ট থাকলে তবে সে নিশ্চয়তা পেতে পারে। এমনও হয় শুধু দলীয় রাজনৈতিক পরিচয়ে পদ পদবী বাগিয়ে নেয়।

ছাত্র রাজনীতির চিত্র আরও হতাশাজনক। পড়ালেখা করার চেয়ে ক্ষমতা যশ খ্যাতি টাকার জন্যই পদ পদবী সংগ্রহ করে। সেটাও আবার টাকার বিনিময়ে সংগ্রহ করে। পদ পদবী হয়ে গেলে আর কে পায়।

রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে পরে আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা ঠিকমতো না হওয়া, গবেষণা কম হওয়া বা কমে যাওয়া এর ফলও আমরা পাচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার মান ও গবেষণার দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ছে। বিশ্বে তো নয়ই এশিয়া মহাদেশেও রেংকিং স্কোর ভালো নয়।

পৃথিবীর অনেক দেশেই ছাত্র রাজনীতি নাই। উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণা আর পড়ালেখা নিয়েই কাজকারবার। এবং হওয়াও উচিত তাই।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯ তম ব্যাচের গণিত বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মামুন তার একটি লেখায় তুলে ধরেন, ” চীনে ছাত্ররাজনীতি নাই। চীনের ছেলে-মেয়েরা দুনিয়া দখল করে নিচ্ছে। আমেরিকা-জাপান, জার্মানী কিংবা কানাডায়—চীনের ছেলে-মেয়েদের জয়জয়কার। দুনিয়ার এমন কোন সেরা বিশ্ববিদ‍্যালয় নেই যেখানে তারা নাই। সারা পৃথিবীতে তারা এখন টপার। এমন গবেষণা প্রতিষ্ঠান দুনিয়াতে খুব কম যেখানে চীনের ছেলে-মেয়েদের প্রভাব নাই। ছাত্রদের যেটা কাজ, যেটা দায়িত্ব, ওরা সেটাই করছে। অন‍্যকিছু করে সময় নষ্ট করলে নিজে যেমন বিশ্বদৌঁড়ে পিছিয়ে যেতো, তেমনি ওদের দেশও পিছিয়ে পড়তো। ইউরোপের বিশ্ববিদ‍্যালয়ে কোন দলীয় দাসত্বের ছাত্ররাজনীতি নাই। আমেরিকায় নাই। কানাডায় নাই। জাপানে নাই। দক্ষিণ কোরিয়া নাই। সিঙ্গাপুরে নাই। ওরা চাঁদে যাচ্ছে। মঙ্গলে যাচ্ছে। ওরা পৃথিবীর সকল মহামারিতে ওষুধ, ভ‍্যকসিন নিয়ে হাজির হচ্ছে। প্রযুক্তি নিয়ে হাজির হচ্ছে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করছে। বুলেট ট্রেইন তৈরি করেছে। কি না করছে! ” কিন্তু আমাদের সুযোগ নেই তাই হচ্ছে না। আমাদের মেধাবীরা চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে।

আমাদের যেসব স্টুডেন্টদের সামর্থ‍্য আছে কিংবা যোগ‍্যতা আছে তারা দেশ ছাড়বে এটাই স্বাভাবিক। যে জাতি সময় থাকতে, চোখ খুলে অন‍্যের কাছ থেকে শিখে না, তাকে শেখানো কঠিন। যে জাতি মেধার মূল্যায়ন করবে না সে জাতির মেধা জন্ম নিবে না। জন্ম হলেও দেশে থাকবে না এটাই সত্যি।

আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান এবং গবেষণা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। আর এর জন্য প্রথমেই দলীয় রাজনীতি বন্ধ করতে হবে । গবেষণা বাজেট বাড়াতে হবে, মেধাবী শিক্ষক ও গবেষকদের মূল্যায়ন করতে হবে। প্রকৃত মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। প্রকাশনা বাড়াতে হবে। গবেষণা এবং প্রকাশনা বিবেচনায় শিক্ষক ও মেধাবী ছাত্রদের প্রণোদনা ও বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই মেধাবীরা উৎসাহী হবে। বাড়বে গবেষণা, বাড়বে শিক্ষার মান।

About somoyer kagoj

Check Also

গোপন কার্যকলাপ উন্মোচিত হলে, সিন্ডিকেট কার্যকলাপ বন্ধ হতে বাধ্য

কামরুন নাহার:  সাধারণত সিন্ডিকেট বলতে একদল ব্যবসায়ী বা মধ্যস্বত্বভোগীদের এমন একটি গোষ্ঠীকে বোঝায়, যারা বাজারের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *