Monday , April 21 2025

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস জরুরি

ড. কামরুজ্জামান:
শিক্ষক, কলামিস্ট ও গবেষক:

নিরব ঘাতকের মতো যে সমস্যাটি দেশে ভয়াবহ হচ্ছে তাহলো এডিস মশার উপদ্রব। দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহন করে বিভিন্ন সংস্কার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে। প্রতিবছরই আমাদের দেশে ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ ধারণ করে । এবছর দেশে নানান রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকায় সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সরকারি লোক রাজনৈতিক নেতা সবাই ভুলে গেছে ডেঙ্গুর আক্রমণের বিষয়টি। অথচ অনেক খবরের ভীড়ে প্রতিদিন দেখা যায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। মারাও যাচ্ছে মানুষ। মিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, এ বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১২৪ জনে। আর গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৯৯ জন। এতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ২৬৫ জনে। কিন্তু দেশে ডেঙ্গু মশা নিয়ে নেই কোনো সচেতনতা, নিয়ন্ত্রণে নেই কোনো পদক্ষেপ বা কার্যকরী উদ্যোগ।

শুধু আমাদের দেশে নয় বিশ্বের অনেক দেশেই ডেঙ্গু মশার উপদ্রব দেখা যায়। তবে উন্নত দেশগুলো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সচেতন। এবং ডেঙ্গু মশার উপদ্রব যাতে বাড়তে না পারে তার জন্য তারা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করে। এডিস মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে এটিই কার্যকরী পদক্ষেপ।

প্রথমেই আসা যাক ডেঙ্গু কি তা নিয়ে আলোচনা করা। ডেঙ্গু হচ্ছে একধরনের জ্বর যা এডিস মশার আক্রমণে হয়ে থাকে। ডেঙ্গু জ্বর একটি এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস জনিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সাধারণত ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। উপসর্গগুলির মাঝে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, পেশি ও গাঁটে ব্যথা এবং গাত্রচর্মে ফুসকুড়ি।

এডিস মশা যাকে কামড় দিবে তার শরীরে জ্বরসহ উপসর্গ দেখা দিবে। যা ডেঙ্গু জ্বর নামে পরিচিত। ডেঙ্গু জ্বর হলে রোগীর শরীরে রক্তের প্লাটিনাম আস্তে আস্তে কমে আসে। প্রাথমিক পর্যায়ে সচেতন না হলে কখনও কখনও ডেঙ্গু জ্বরে রোগীর অবস্থা বিপদজনক হতে পারে। তবে রক্তে প্লাটিনাম কমে আসলেও সেবাশুশ্রূষা এবং তরল খাবার গ্রহণের মাধ্যমে রোগী স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। ডেঙ্গু জ্বর দেখা দিলে রোগী স্বাভাবিক পর্যায়ে আসতে ১৪ থেকে ১৬ দিন সময় লাগে। সাধারণ এডিস মশায় কামড় দিলে রোগীর শরীরে ৪ থেকে ৫ দিন পর উপসর্গ দেখা দেয়। তবে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। মানসিকভাবে শক্ত থেকে সচেতনতা অবলম্বন করে ডেঙ্গু জ্বর মোকাবিলা করা যায়।

আমাদের দেশে এডিস মশার আক্রমণে মানুষ সাধারণত অসুস্থ হয় বর্ষাকালে জুন মাস থেকে অক্টোবর মাসের শেষ সময় পর্যন্ত। এই সময় এডিস মশার বংশ বিস্তার এবং আক্রমণ দুটোই বেড়ে যায়।

ডেঙ্গু জ্বরে রোগী আক্রান্ত হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের তত্বাবধানে থাকবে হবে। বর্ষাকালে শরীরে জ্বর হলে অবশ্যই ডেঙ্গু টেস্ট করা প্রয়োজন। ডেঙ্গু রোগীর প্রাথমিক উপসর্গ হচ্ছে জ্বর। এই জ্বর কম বা বেশি হতে পারে।

বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানা যায়, ডেঙ্গু জ্বর হলে প্যারাসিটামল ছাড়া ওষুধ গ্রহন করা যাবে না। ডেঙ্গুর জন্য এখনও সেভাবে কোনো প্রতিষেধক আবিস্কৃত হয় নি। ডাক্তারের পরামর্শই গ্রহণ করতে হবে। তবে রোগীকে অবশ্যই তরল খাবার খেতে হবে। এর মধ্যে – লেবু মাল্টার শরবত বেশি করে খাওয়া উচিত। স্যালাইন খেতে হবে পর্যাপ্ত। বেশি করে পেঁপে খেতে হবে। অর্থাৎ লিকুইড খাবার খেতে হবে বেশি করে।

এতো গেলো ডেঙ্গু জ্বর এবং ডেঙ্গু রোগীর জন্য করণীয় সম্পর্কে আলোচনা। এবার আসা যাক এডিস মশার উৎসস্থল, বংশ বিস্তার এবং আক্রমণ সম্পর্কে আলোচনায়।

আমাদের দেশে একসময় ধারণা করা হতো এডিস মশা শহরে মশা। এখন ধারণা পরিবর্তন হয়েছে। সারা দেশেই এখন এডিস মশা আক্রমণ দেখা যায়। সারা দেশেই ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়। এতে বুঝা যায় – ডেঙ্গু মশার উপদ্রব এখন দেশজুড়েই।

কেন হয় ডেঙ্গু মশার বিস্তার? আমাদের দেশে মশার উপদ্রব একটু বেশি। এর কারণ হচ্ছে – পরিবেশ দূষণ। পরিবেশ নানা কারণেই দূষিত হচ্ছে। হয়ে আছে। পরিবেশের দূষণ থেকে মশা-মাছির বংশবিস্তার বেশি হয়। মানুষের বাসাবাড়ির ময়লা আবর্জনা যত্রতত্র ফেলে রাখার জন্য পরিবেশ সবচেয়ে বেশি দূষিত হয়। এর মধ্যে ডাবের খোসা, গাড়ির চাকা, টায়ার টিউব, পলিথিন, চিপসের প্যাকেট ইত্যাদি অন্যতম। এডিস মশার বংশ বৃদ্ধি হয় মূলত জমে থাকা পানি থেকে।

ডাবের খোসা, গাড়ির চাকা, টায়ার টিউব, পলিথিন, চিপসের প্যাকেট ইত্যাদিতে পানি জমে থাকে দীর্ঘ সময়। জমে থাকা পানি দূষিত হয়ে মশার বংশবৃদ্ধি ঘটায়। এছাড়াও বাসাবাড়ির ফুলের টব, ফুলদানি, ছাদবাগানের টপ ও ড্রাম যেগুলোতে পানি জমে থাকে সেগুলো থেকে এডিস মশার বংশবিস্তার হয়।

তাছাড়া এসির জমে থাকা পানি, ফ্রিজের নিচে জমে থাকা পানি থেকে এডিস মশার উৎপত্তি হয়। আমাদের দেশে সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় ময়লা আবর্জনা যত্রতত্র ফেলে রাখার কারণে এবং সেসব ময়লা আবর্জনা ড্রেনে জমে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। আর ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে মশার উপদ্রব। এর মধ্যে এডিস মশার উপদ্রবও বাড়ে।

আগে বলা হতো এডিস মশা শুধু দিনের বেলায় কামড়ায়। বিকাল থেকে সন্ধ্যার সময়ে বেশি আক্রমণ করে। কিন্তু এর কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা নেই। এখন দেখা যায় রাতদিন সমসময়ই এডিস মশা আক্রমণ করে থাকে। এডিস মশা সব বয়সী মানুষকেই কামড়ায় তবে শিশু ও কিশোররা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। এর কারণ হচ্ছে – শিশুরা দীর্ঘসময় ঘুমায়। মশারী টানানো না থাকলে এডিস মশায় আক্রমণ করে। কিশোররা টেবিলে বসে পড়ালেখা করার সময় এডিস মশার আক্রমণের শিকার হয়।


এডিস মশা থেকে নিয়ে নিরাপদ থাকার উপায় হচ্ছে – এডিস মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করা। আমাদের দেশে প্রতিবছর বর্ষায় ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়লে হাসপাতাল গুলোতে নেওয়া হয় বাড়তি সুবিধার ব্যবস্থা। করা সুনির্দিষ্ট ডেঙ্গু রোগীর হাসপাতাল। অথবা অনেক হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর জন্য আলাদা সাইড করা হয়। বাড়তি চিকিৎসা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বরাদ্দ বাড়ানো হয়। এগুলো নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এতোসব কিছু করেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। ডেঙ্গু মশার উৎসস্থল ধ্বংস করতে না পারলে ডেঙ্গু জ্বর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়। তাই আগে ডেঙ্গু মশার উৎসস্থল ধ্বংস করতে হবে। এর জন্য –
বাসাবাড়ির ময়লা আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। বাড়ির আঙ্গিনায়, আশপাশে ডাবের খোসা, টায়ার টিউব, পলিথিন ও চিপসের প্যাকেট ফেলে রাখা যাবে না। এগুলোতে পানি জমতে দেয়া যাবে না। একটা নির্দিষ্ট এলাকার ( সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ) ময়লা আবর্জনা পরিশোধনের ব্যবস্থা করতে হবে। নদী খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয়ে ময়লা আবর্জনা ফেলা যাবে না।
বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত ফুলের টব, ফুলদানি, ফ্রিজ, এসি ইত্যাদিতে পানি জমে রাখা যাবে না। ফুলের টব ও ফুলদানির পানি প্রতিদিন পরিবর্তন করে দিতে হবে। এসি ফ্রিজের পানি প্রতিদিন অপসারণ করতে হবে।
সরকারীভাবে ময়লা আবর্জনা অপসারণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অতিরিক্ত বরাদ্দ দিতে হবে। বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে দেশব্যাপী ডেঙ্গু মশার উৎসস্থল ধ্বংসে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। ধোঁয়া দিয়ে মশা নিধনের পাশাপাশি ড্রেনে জমে থাকা ময়লা আবর্জনা সরাতে হবে।

নির্মাণাধীন বাড়ি, পরিত্যক্ত বাড়িঘর, পরিত্যক্ত গাড়ি ও অব্যবহৃত প্লাস্টিক সামগ্রী যেখানে পানি জমে থাকতে পারে এগুলো পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এগুলোতে এডিস মশা বংশবিস্তার করে থাকে।

দিনে বা রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারী ব্যবহার করতে হবে। ছেলেমেয়েরা পড়ালেখার টেবিলে বসার সময় মশা নিরোধক ওষুধ বা স্প্রে ব্যবহার করতে হবে।
এডিস মশা বংশবিস্তার রোধে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। মিডিয়াকে কাজে লাগাতে হবে। অসচেতন বাসাবাড়ির মালিকদের জরিমানার আওতায় আনতে হবে। সাধারণ নাগরিক যারা এডিস মশা বংশবিস্তার রোধে কাজ করবে তাদের পুরস্কৃত করতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনকে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। তবেই সম্ভব হবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ।

About somoyer kagoj

Check Also

আত্মঘাতী বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি টানেল প্রভাব ও শিক্ষা সংস্কার কমিশন

ড. মোঃ আবু হাসান:বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার কর্মকর্তা, অর্থনীতির শিক্ষক ও গবেষক অর্থনীতিতে ‘টানেল প্রভাব’ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *