স্টাফ রিপোর্টার : ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশের অন্যতম বেসরকারি সংস্থা উদ্দীপন সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক মানুষের স্বাবলম্বি করতে কাজ করে আসছিল। বছর তিনেক আগেও এই সংস্থা নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হতো, সেখানে বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান ও গ্রাহকদের সন্তুষ্টি নিশ্চিত করা হতো। কিন্তু এনজিওতে কাজ করার কোন অভিজ্ঞতা না থাকলেও এই সংস্থার নির্বাহী পরিচালক হিসেবে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয় বিদ্যুৎ কুমার বসুকে। তারপর থেকে সাবেক সচিব মিহির কান্তি মজুমদার, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার, পলাতক পুলিশ কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার, ভারতীয় নাগরিক বিজয়ের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে বিপুল অর্থ উদ্দীপন থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন তারা।
এসব নিয়ে উদ্দীপনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের মুখে গত ৪ সেপ্টেম্বর বুধবার পদত্যাগ করতে বাধ্য হন বিদ্যুৎ কুমার বসু।
গত অর্থ বছরের হিসাব অনুযায়ী উদ্দীপন গঠনতন্ত্র বিরোধী নানা আর্থিক খাতে অংশ নিয়ে বিপুল টাকা লোকসানে পড়ে। ক্ষুদ্র ঋণের বাইরে খোলা পানিতে মাছ শিকার, ইটভাটা, ব্যাটারি কারখানা, কুমিরের খামারসহ যতগুলো বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সবগুলোর মাধ্যমেই সংস্থা থেকে বিপুল অর্থ লোপাট করেছে এই চক্রটি। উদ্দীপন এগ্রো প্রকল্পের আওতায় কোটি কোটি টাকা আত্মসাতেরও অভিযোগ রয়েছে।
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে উদ্দীপন সংস্থা ৯৪ কোটি লোকসানে রয়েছে। তারপরও ছয় কোটি লাভ দেখিয়ে অডিট রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটির নির্দেশনা অমান্য করে বিদ্যুৎ কুমার বসু গংরা কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছে। লুট করা টাকায় নির্বাহী পরিচালক বিদ্যুৎ কুমার বসু গার্মেন্টস ও আইটি ফার্ম করেছেন, ঢাকার উত্তরায় বাড়ি করেছেন। বোর্ড মেম্বার শওকতের সঙ্গে আলাদা একটি এনজিও তৈরি, সপ-আপ নামের একটি অনলাইন মার্কেটিং কোম্পানির শেয়ার ক্রয়সহ উদ্দীপনের বাইরে নানামুখী ব্যবসা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। একই সঙ্গে বিপুল অর্থ ভারতে পাচার করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, বেপরোয়া লুটপাট ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে দেশের অন্যতম সেরা এনজিও উদ্দীপন আজ ধ্বংসের পথে। ৪০ বছরের প্রতিষ্ঠিত ও দেশের অন্যতম বৃহৎ এনজিও উদ্দীপন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক বিদ্যুৎ কুমার বসু সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারিদের নিকট এক মূর্তিমান আতঙ্ক। সংস্থার সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান, সাবেক সচিব মিহির কান্তি মজুমদার এবং তার ভাই বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার, বহুল আলোচিত ডিএমপির ক্রাইম থেকে সর্বশেষ ডিবিতে যাওয়া বিপ্লব কুমার ও বিজয় নামের এক ভারতীয় নাগরিকের প্রভাবে তিনি উদ্দীপনে হিন্দুত্ববাদীর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন।
সাত হাজার জনবলের এই সংস্থায় ১০ লাখ গ্রাহক, প্রায় সাত লাখ ঋণ গ্রহিতা নিয়ে সারা দেশে ঋণ বিতরণ ও সঞ্চয় গ্রহণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।
আগে এনজিওতে কাজ করার কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই গ্রামীণ ফোন, টেলিনর গ্রুপ, রবি, আজিয়াটা গ্রুপ ও সিটিসেলসহ দেশের টেলিযোগাযোগ মাধ্যমে চাকুরি করা বিদ্যুৎ কুমার বসুকে এই সংস্থান নির্বাহী পরিচালক হিসেবে ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯ নিয়োগ দেওয়া হয়।
নৈতিক ও আর্থিক কেলেঙ্কারীর জন্য আগের কোম্পানিতে তার নামে ঋণের মামলা ছিল। বিদ্যুৎ কুমার বসু উদ্দীপনে যোগ দিয়ে সেখান থেকে বিশেষ কোটায় ২৫ লাখ টাকা নিজের নামে ঋণ তোলেন। সে টাকা তিন বছরের মধ্যে পরিশোধ করার কথা থাকলেও মাত্র সাত লাখ প্রদান করেছেন, এখনও বকেয়া রয়েছে ১৮ লাখ।
ভারত থেকে আসা বিজয় নামের একজন ব্যক্তির মাধ্যমে সংস্থার নানা কাজ করানো হয়। বিশেষ করে আইটি সেক্টরের সব কাজ ও যন্ত্রপাতি ক্রয় তিনি করে থাকেন। উদ্দীপনে ঋণ পেতে গ্রাহকদের হেলথ কার্ড বাবদ সাড়ে ১২শ টাকা কর্তন করা বাধ্যতামূলক। দেশের গরিব অসহায় মানুষ, তাদের সঞ্চয়ও জমা রয়েছে এই সংস্থায়, বিশেষ প্রয়োজনে ঋণ নিতে তারা বাধ্য হয়ে এই টাকা প্রদান করেন। লাখ লাখ গ্রাহকের এই হেলথ কার্ডের কোটি কোটি টাকার কোন হিসাব নেই। ভারতীয় প্রোব নামের একটি স্বাস্থ্য বিষয়ক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির আলোকে এসব টাকা সরানো হয়েছে। সফটওয়্যার কেনা ও আইটির যন্ত্রপাতি আমদানি করার নামে এই কোটি কোটি টাকা সবই ভারতে পাচার করা হয়েছে একটি সূত্র দাবি করেছে। এই চক্রের সঙ্গে সম্প্রতি উদ্দীপনের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্থ আস্থাবাজন, পলিসি মেকার একান্ত সচিব, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের কিউরেটর নজরুল ইসলাম খান (এন আই খান)। তিনি পিকে হালদার গংদের আত্মসাৎ করা ২৫০০ কোটি টাকা জায়েজ করার ব্যবস্থা করেছিলেন। এছাড়াও ১০৫ কোটি টাকার ঋণ খেলাপীর মামলায় উদ্দীপন এনজিওর সাবেক চেয়ারম্যান পিকে হালদারের ঘনিষ্ঠ ও আস্থাবাজন ড. মিহির ক্রান্তি মজুমদারকে অব্যহতি দেওয়ার কাজটিও তিনি করেছিলেন।
নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে বিদ্যুৎ কুমার বসু উদ্দীপন অফিসে যা খুশি তাই করেছেন। সেখানে অধিকাংশই মুসলিম কর্মকর্তা-কর্মচারি, হাতে গোনা কয়েকজন হিন্দু ধর্মালম্বীর কারনে কেন্টিনে কখনও গরুর মাংস রান্না হয় না। এমনকি রোজার সময়ও রোজাদার কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ইফতার ও নামাজের ব্যবস্থা রাখেননি। এসব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অসন্তোষ চলে আসলেও শীর্ষ পর্যায়ের সকল কর্মকর্তা হিন্দুত্বের অনুসারী ও প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস করেননি।
বিদ্যুৎ কুমার বসুর পদত্যাগের পরে উদ্দীপন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আনন্দময় পরিবেশ ফিরে এসেছে। অবিলম্বে তার বিরুদ্ধে আসা সব অভিযোগ তদন্ত সাপেক্ষ বিচারের দাবি জানিয়েছেন তারা।