Friday , October 11 2024

বিশ্ব বিবেকের সামনে গাজায় দুর্ভিক্ষ, হাহাকারক্ষুধায় মৃত্যুর মুখে লাখো মানুষ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের গাজায় ত্রাণ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় যে অস্বাভাবিক মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে, তাতে পাঁচ শিশু সন্তানের মা নারিমিন তাফেসের জীবনে নেমে এসেছে দুঃখের মরুঝড়। অনেক মায়ের মতো তিনিও পারছেন না সন্তানদের মুখে এক টুকরো রুটি তুলে দিতে। ক্ষুধায় তাদের আর্তচিৎকারের মধ্যে তিনি শুধু চোখের পানি ফেলেন।

উত্তর গাজার বাসিন্দা নারিমিন বলেন, ‘সন্তানরা সব সময় ক্ষুধায় কান্না করে, রুটি চায়। আমার কিছুই করার থাকে না। সবচেয়ে ছোট ছেলের বয়স চার বছর। যুদ্ধ শুরুর আগে সে প্রাণচঞ্চল ছিল, খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকত। এখন সারাক্ষণ শুয়েই থাকে। প্রতি রাতে আমি সন্তানদের সঙ্গে এই উদ্বেগ নিয়ে ঘুমাই যে, সকালে উঠে তাদের জীবিত পাই কিনা।’

জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের উদ্ধৃতি দিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনপিআর জানায়, যুদ্ধচালে ফেব্রুয়ারিতে গাজায় দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি বেড়েছে দ্বিগুণ। গত মাসে এ পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেছে। গাজার কোথায়ও খাবার, বিদ্যুৎ, পানি নেই। তাই মানবিক সংকট, খাদ্যাভাবে দুর্ভোগ-মৃত্যুর প্রকৃত চিত্রও গণমাধ্যমে আসে না। উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ নেই। এ কারণে পুষ্টিহীনতায় প্রকৃত মৃত্যুর চিত্র পাওয়া যায় না।

গত মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত অপুষ্টিতে ২৫ শিশুর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও পরিস্থিতি দিন দিন যথেষ্ট খারাপের দিকে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, খাদ্যাভাবে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি।

গাজা সিটির আল দারাজ শহরতলিতে কন্যাদের নিয়ে বোনের বাড়িতে থাকেন রিউয়া মাসুদ সাঈদ। গত নভেম্বরের মধ্যভাগে তাঁর বাড়িতে ইসরায়েল বিমান হামলা চালায়। এতে তাঁর স্বামীসহ কয়েকজন নিহত হন। পরে জাতিসংঘ পরিচালিত একটি আশ্রয়কেন্দ্রে তারা ওঠেন। সেখান থেকে সন্তানদের নিয়ে ভাইয়ের বাসায় আশ্রয় নেন। তখন আরেকটি বিমান হামলায় নিহত হন তাঁর ভাই। তৃতীয় বিমান হামলায় তাঁর এক মেয়ে নিহত হয়। রিউয়া মাসুদ বলেন, ‘আমরা ফিলিস্তিনিরা যে কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তা কেউ কখনও পায়নি; কখনও পাবেও না।’

সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উত্তর গাজায় এখনও কয়েক লাখ মানুষের বাস। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ কমিটি সম্প্রতি সতর্কতা জারি করে বলেছে, সেখানে এরই মধ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। লোকজন বিপর্যয়কর পর্যায়ে ক্ষুধায় ভুগছে। ইসরায়েল ত্রাণ সরবরাহকে বাধাগ্রস্ত করছে। শত শত ত্রাণবাহী ট্রাক সীমান্ত ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে আছে; ত্রাণকর্মীদের গুলি করে হত্যা করছে। ত্রাণপ্রত্যাশী ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালানো হচ্ছে। এ অবস্থায় সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বিচার আদালত ত্রাণ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত না করতে আদেশ দেয়। কিন্তু ইসরায়েল তা আমলে নেয়নি। এ নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে খোদ ইসরায়েলের গণমাধ্যমেই। হারেৎজ অনলাইনের প্রতিবেদনে ক্ষুধাকে অস্ত্র বানানো এবং তা অস্বীকার করা নিয়ে বলা হয়েছে, ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের ইতিহাসে এটা সবচেয়ে কুৎসিত দৃশ্য।

কার্যত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধে ক্ষুধার্ত রেখে মানুষ হত্যার দৃষ্টান্ত আর নেই। সবার চোখের সামনে এ মানবিক বিপর্যয় ঘটলেও কেউ ঠেকাতে পারছে না ইহুদিবাদী দেশটিকে।

রোববার প্রকাশিত জেফারসন পাবলিক রেডিও অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়, খাদ্যভাবে ফিলিস্তিনিরা সাগরের নোনাপানিতে সিদ্ধ করা ঘাস খাচ্ছেন। অনেকে পোষা প্রাণীর খাবার খাচ্ছেন। এক কিশোরীকে বলতে শোনা যায়, ‘যদি বোমা আমাদের না মারে, ক্ষুধা মারবে।’

চলমান পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধবিরতির আহ্বান জোরালো হচ্ছে। সম্প্রতি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস হলেও তা মানছে না ইসরায়েল। গাজায় ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ করে ইচ্ছাকৃতভাবে অনাহারে রেখে মানুষ হত্যাকে ‘যুদ্ধাপরাধের শামিল’ হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তা ভলকার তুর্ক।

গত সপ্তাহে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ফিলিস্তিনের বেসামরিক মানুষের সুরক্ষা দেওয়া ইসরায়েলের আইনি দায়িত্ব। তাদের উচিত মানবিক ত্রাণ সরবরাহ নিশ্চিত করা। কিন্তু ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তারা তা করছে না। তারা ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে, যা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

রোববার দ্য গার্ডিয়ান অনলাইনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধ আন্তর্জাতিক আইন মেনে হচ্ছে কিনা– সে প্রশ্ন সামনে এসেছে। কারণ তারা গাজায় খাবার, পানি ও জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। যেভাবে তারা হত্যাকাণ্ড, ধ্বংসযজ্ঞ ও মানবিক সংকট তৈরি করেছে, তাতে যুদ্ধাপরাধ সংগঠনের সমূহ ঝুঁকি রয়েছে।

গত জানুয়ারিতে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেন, ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন মেনে যুদ্ধ করছে কিনা, তা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন। যুদ্ধে গতকাল সোমবার পর্যন্ত ৩২ হাজার ৮৪৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। প্রতিদিনই মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। ইসরায়েল বেপরোয়াভাবে সংঘবদ্ধ শাস্তি দিচ্ছে।

চলমান পরিস্থিতিতে নতুন করে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন পোপ ফ্রান্সিস। আয়ারল্যান্ডের সেন্ট পিটার স্কয়ারে সমবেত জনগোষ্ঠীর সমানে তিনি এ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমি আবারও গাজায় মানবিক সহায়তা ত্রাণের স্বাভাবিক সরবরাহের আহ্বান জানাচ্ছি এবং সব জিম্মির মুক্তির বিনিময়ে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি চাইছি।’

About somoyer kagoj

Check Also

রতন টাটার মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ মমতা, বললেন— অপূরণীয় ক্ষতি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন ভারতের টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার রতন টাটা। বয়সজনিত সমস্যা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *