নিজস্ব প্রতিবেদক:
ঢাকার সীমানা চিহ্নিত করার পাশাপাশি এবং স্থলপথে শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে ৩৬৪ বছর আগে রমনা এলাকায় একটি ফটক নির্মাণ করেছিলেন বাংলার সুবেদার মীর জুমলা। সে সময় লোকমুখে এটি মীর জুমলা ফটক নামেই অধিক পরিচিতি পায়। কিন্তু ফটকটি ‘ঢাকা ফটক’ নামে নির্মাণ করা হয়েছিল। তার ১৬৪ বছর পর ১৮২৫ সালে কোম্পানি শাসন আমলে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডাওয়ে ফটকটি সংস্কার করেন। তারপরই এটি ‘ঢাকা গেট’ নামে সর্বাধিক পরিচিতি পায়। এরও দুই শত বছরের মাথায় এসে আরেক দফা সংস্কার শেষে ‘ঢাকা গেট’ নামেই এটি উদ্বোধন করা হল। আরেক দফায় খুলল ঢাকার দুয়ার।
বিষয়টি ঢাকাবাসী ও বাংলার মানুষের জন্য অত্যন্ত আনন্দের বলে মনে করেন ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন। বুধবার (২৪ জানুয়ারি) বিকেলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নিজের অভিব্যক্তি জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এই যে ফটকটি আজকে ঠিক ২০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এটির উদ্বোধন হল। ১৮২৩ বা ২৪ সালে এটার নির্মাণকাজ শুরুর সময়। যখন রমনা এলাকা পরিষ্কার করা হয়। এখন ২০২৪ সাল। ঠিক ২০০ বছর লাগল। সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দন।’
ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ দিকে ফটকটির ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। দুই দিকের ছোট বুরুজগুলো এবং বুরুজের চূড়ার আমলা-কলসগুলো ভেঙে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসনামলে গভর্নর মোহাম্মদ আজম খানের সময়ে সড়কটি চওড়া করা হয়। সে সময় ফটকের পূর্ব অংশের বড় বুরুজটি নবনির্মিত সড়কদ্বীপে রেখে বাকি অংশ পুরোপুরি ভেঙে ফেলা হয় এবং নতুন সড়কের পূর্ব পাশে একটি অবিকল প্রতিরূপ তৈরি করা হয়। তারপর সেটি আবার ধ্বংসের মুখে পতিত হয়। এই ধ্বংসপ্রাপ্ত ঐতিহাসিক ফটকটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। এটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব জনসাধারণের কাছে তুলে ধরতে ফটক ঘিরে তৈরি করা হয়েছে গণপরিসর। ফটকের পশ্চিমে স্থাপন করা হয়েছে মীর জুমলার আসাম অভিযানের একমাত্র সাক্ষী-বিবি মরিয়ম কামান। পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় গেটটির মূল উপকরণ যেমন চুন, সুরকি ইত্যাদি ব্যবহার করে ডয়লির সময়ের এবং ১৯৬০-এর দশকের অংশগুলোকেও সংরক্ষণ করা হয়েছে। পাশে রাখা হয়েছে কাঁচে ঘেরা একটি ছবিঘর। যেটি সাধারণ মানুষের উন্মুক্ত জাদুঘর হিসেবে রাখা হবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশের সময় মেয়র ফজলে নূর তাপস বলেন, এই ঢাকা ফটকে শুধু দেশবাসী না, সারা বিশ্বের কাছে আমরা আবার তুলে ধরতে পারলাম, পুনর্জীবিত করতে পারলাম। এটা আমাদের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। চারশ বছরের পুরোনো এই ঢাকার ঐতিহাসিক স্থাপনা আমাদের সম্পদ যা বিশ্বের অনেক উন্নত নগরীতেও পাওয়া যাবে না। তারা হয়ত সাগর ভরাট করে স্থাপনা বানাচ্ছে কিন্তু শত বছর আগের ঐতিহ্য তাদের নাই। চারশ বছর আগের এই কামান আরও চারশ বছর পরও মানুষ দেখতে পারবে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য আফম বাহাউদ্দীন নাছিম। তিনিও উৎফুল্ল অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, দেশের প্রখ্যাত স্থপতি ও স্থাপত্য সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আবু সাঈদের নেতৃত্বে একদল বিশেষজ্ঞ গেটটির নতুন নকশা তৈরি করেন। সেই নকশার আদলেই সংস্কার করা হয়। এটা আমাদের জন্য খুবকষ্টসাধ্য কাজ ছিল। তবুও এটি আমরা করতে পেরেছি। এটা সংস্কারের সময় আমরা নানা কাঠখড় পুড়িয়ে গ্রানাইট পাথরও ব্যবহার করেছি।
অধ্যাপক আবু সাঈদ বলেন, যেটা আগে ছিল, ওটাকেই আমরা রিস্টোরেশন করেছি। কিছু জিনিস ভেঙে গিয়েছিল, সেগুলো নতুন করে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ফটকের উপরে কলসের মত যে জিনিসগুলো, একটা কর্নারে বুরুজ ভাঙা ছিল, সেগুলো আমরা সংস্কার করেছি। তার মানে আদি যে ডিজাইনটা ছিল, সেটাকেই আবার নতুনভাবে করা হয়েছে। তবে সেখানে নতুন করে বসার স্থান এবং মীর জুমলার ‘বিবি মরিয়ম’ কামানটা সংযোজন করা হয়েছে।
গেটটি উদ্বোধনের সময় মোঘল আমলের আবহ তৈরি করতে আনা হয়েছিল এক জোড়া হাতি। সেটার সঙ্গে হাতে বল্লমওয়ালা পাইক-পেয়াদাও আনা হয়েছিল। যা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আসা সাধারণ মানুষের আলাদা করে নজর কারে। সংস্কারের পর ঢাকা গেটের নতুন রূপ দেখে ভালো লাগার কথা জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরিফুল শাওন। তিনি বলেন, সময়ের আবর্তে ধুলোর সঙ্গে মিশে যাওয়া একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন আবার নতুন করে স্থাপনের উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে ভালো। যেহেতু এটি পাবলিক প্রোপার্টি তাই আমাদের উচিত হবে এটি নষ্ট না করা। পোস্টার লাগানো বা পানের পিক ফেলার স্থান না বানালে ঐতিহাসিক এই নিদর্শনটি তার পূর্ণ মর্যাদা পাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বরের কাছে জরাজীর্ণ ‘ঢাকা গেইট’র নান্দনিকতা ফেরাতে ২০২২ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। গত বছরের মে মাসে সংস্কার কাজ শুরু হয়, যার কাজ সম্প্রতি শেষ হয়েছে। প্রায় ৮২ লাখ টাকা খরচ করে এ গেইট সংস্কার করেছে ঠিকাদার কোম্পানি আহনাফ ট্রেডিংস। ঐতিহাসিক ঢাকা গেইট তিনটি অংশে বিভক্ত। পশ্চিমাংশ পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স ভবনের পাশ, পূর্বের অংশ পড়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের তিন নেতার সমাধির প্রবেশপথের সামনে এবং মাঝের অংশ পড়েছে দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসিগামী সড়ক দ্বীপে। বর্তমানে ফটকটির উপর দিয়ে মেট্রোরেল চলাচল করে।