নিজস্ব প্রতিবেদক:
আগামীকাল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কিন্তু আগের এগারোটি সংসদ নির্বাচনের চেয়ে এবারের নির্বাচন অন্যরকম, ব্যতিক্রমী। আমার বিবেচনায় এটা নির্বাচন নয়, গণভোট। গণতন্ত্র অব্যাহত থাকবে কিনা সে প্রশ্নে গণভোট। বাংলাদেশের উপর বিদেশি নিষেধাজ্ঞা হবে কিনা, সে বিষয়ে গণভোট। এই নির্বাচনে আপনি কাকে ভোট দিচ্ছেন সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়, আপনার ভোট গুরুত্বপূর্ণ।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ৩০০ আসলে প্রার্থী দেয় বিভিন্ন দল। যে রাজনৈতিক দল ১৫০টির বেশি আসনে জয়ী হয় তারাই সরকার গঠন করে। স্বাধীনতার পর ৭৩ এর নির্বাচন এবং ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত নির্বাচন সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। যেখানে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী দল সরকার গঠন করে।
১৯৭৫ এর ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সংসদীয় ব্যবস্থার বদলে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু ৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি। এরপর জনগণের অভিপ্রায়ে নয়, ক্ষমতার পালাবদল হয় অস্ত্রের শক্তিতে। খুনি মোশতাক, জিয়া, এরশাদ কেউই জনগণের রায়ে ক্ষমতার মসনদে বসেননি। তারা ক্ষমতা দখল করেছে, অস্ত্রের জোরে, পিছনের দরজা দিয়ে।
৭৯ থেকে ৮৮ পর্যন্ত তিনটি জাতীয় সংসদ ছিল আসলে রাবার স্টাম্প। অবৈধ সরকারের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়াই ছিল এই তিনটি সংসদের প্রধান কাজ। ৯০ এ গণআন্দোলনের মুখে এরশাদের পতন হয়। তিনজোটের রূপরেখা অনুযায়ী, ৯১ এর সংসদ আবার ৭২এর সংবিধান অনুযায়ী সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যায়। এরপর দেশে সাতটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ৯৬ এর ১৫ ফেব্রুয়ারির সংসদ নির্বাচন ছিল একটি প্রহসন। ভোট ছাড়া অনুষ্ঠিত ঐ সংসদের আয়ু ছিল এক মাসেরও কম।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে স্বল্প মেয়াদের সংসদে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংবিধান সংশোধনী গৃহীত হয়। ৯১ এর সংসদও শেষ হয়েছিল মেয়াদ পূর্তির কিছুদিন আগে। ৯৬ এর জুনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদই প্রথম মেয়াদপূর্ণ করে। ৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচন (৯৬ এর ১৫ ফেব্রুয়ারির প্রহসন বাদ দিলে) অনুষ্ঠিত হয়েছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এই চারটি সংসদ নির্বাচনে প্রতিবারই ক্ষমতার বদল হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থই দাঁড়ায় ক্ষমতাসীন দল হেরে যাবে। এরকম বাস্তবতায় ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি-জামায়াত জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে দলীয়করণ করার ‘সাংবিধানিক ক্যু করে।
বিএনপি-জামায়াত সংবিধান সংশোধন করে প্রধান বিচারপতির বয়স বৃদ্ধি করে যেন তাদের একান্ত অনুগত সাবেক আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারেন। নানা রকম কারসাজি করে ২৮ অক্টোবর ২০০৬ সালে বিএনপি শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ছেড়ে দেয় তাদের বাধ্যগত রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজ উদ্দিন আহমদকে। ইয়াজ উদ্দিনের নেতৃত্বে বিএনপির বি টিম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নেয়। ঐ দিনই মূলত: বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মৃত্যু ঘটে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে এমনভাবে বিএনপি দিগম্বর করে যে, এর সুযোগ গ্রহণ করে বাংলাদেশের সুশীল সমাজ। ২০০৭ সালের এক-এগারো ছিল সুশীলদের ক্ষমতা দখল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবাধানিক ফোঁকড় দিয়ে দেশে অনির্বাচিত সরকারের চিরস্থায়ী ক্ষমতা দখলের সুযোগ সৃষ্টি হয়। জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ এবং ড. ফখরুদ্দীনের ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থায় মানুষ তিক্ত বিরক্ত ওঠে।
এ সময় এই অনির্বাচিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তৈরি হয় জনমত। বেগম জিয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই অনির্বাচিত ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে মতামত দেন। তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চ্যালেঞ্জ হয় বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টে। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল হয়।
২০১৪ থেকে দুটি নির্বাচন হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে। ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করে। তাদের ঐ সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল, তা বিএনপির নেতারাই স্বীকার করেন। ঐ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস অন্যরকম হতো।
২০১৮ সালে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের একটি মহা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা কিছু গণতন্ত্র বিরোধী অপশক্তি সেই সম্ভাবনাকে নষ্ট করে। ২০১৮ সালে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে নব্য আওয়ামী লীগার প্রশাসন এবং চাটুকাররা। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর আস্তে আস্তে গণতন্ত্র বিরোধী অপশক্তি সংঘবদ্ধ হতে শুরু করে। পশ্চিমা বিশ্ব, সুশীল সমাজের একটি অংশের ক্রীড়নকে পরিণত হয় রাজনৈতিকভাবে প্রায় দেউলিয়া বিএনপি। নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু এবং ‘অংশ-গ্রহণমূলক’ নির্বাচনের আওয়াজ তুলে শুরু হয় সংবিধান এবং গণতন্ত্র হত্যার ষড়যন্ত্র।
একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশ নিয়ে শুরু করে অতিমাত্রায় মাতামাতি। ভিসা নিষেধাজ্ঞাসহ নানা নিষেধাজ্ঞার ভয় দেখানো শুরু হয়। অন্যদিকে পশ্চিমাদের আপনজন সুশীলরা গণতন্ত্রের জন্য আহাজারি শুরু করেন। এসবেই আশার আলো দেখতে শুরু করে বিএনপি। নিজেরা ক্ষমতায় যেতে নয় বরং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে সবকিছুকে করার মুচলেকা দেয় বিএনপি।
নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় না হলে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয় দীর্ঘ ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি। এদের সঙ্গে যুক্ত হয় কিছু খুচরা দলও। বিএনপির আন্দোলনে বাতাস দেয় পশ্চিমা বিশ্বের কয়েকটি দেশ এবং দেশের সুশীল সমাজের একটি অংশ। এদের অভিন্ন লক্ষ্য হলো, যে কোনো মূল্যে নির্বাচন হতে না দেওয়া। সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করে একটি অসাংবিধানিক সরকারকে ক্ষমতায় বসানো। অন্যদিকে, শেখ হাসিনা যেকোনো মূল্যে গণতন্ত্র এবং সংবিধান রক্ষার প্রত্যয় ঘোষণা করেন। গত দুই বছর ধরে আসলে এই দুই ধারার লড়াই দৃশ্যমান। আস্তে আস্তে মনস্তাত্বিক যুদ্ধ থেকে এই যুদ্ধ এখন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। নির্বাচন বানচাল করে বাংলাদেশকে গণতন্ত্র হীন করতে চায় একপক্ষ। অন্যদিকে গণতন্ত্র এবং সংবিধানকে এগিয়ে নিতে চায় আরেক পক্ষ। আর এই লড়াইয়ের ফয়সালার দিন ৭ জানুয়ারি ।
৭ জানুয়ারি যেন নির্বাচন না হয় সেজন্য সব চেষ্টাই করা হয়েছে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ধুয়া তুলে নির্বাচনকে অনিশ্চিত করে তোলার সব চেষ্টাই ছিলো দৃশ্যমান। বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দলকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার চেষ্টাও সফল হয়েছে। আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই দেশে একটি নির্বাচনী আবহ তৈরি করেছে। জাতীয় পার্টি এখনও দোদুল্যমান। থেকেও নেই। অবস্থা বেগতিক দেখলে তারা যেকোনো কিছুই করতে পারে। তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম ভোটে না থাকার মতোই। স্বাভাবিকভাবে, সাধারণ ভোটারদের কাছে আপাতঃ দৃষ্টিতে এই ভোট আগ্রহহীন, উত্তেজনা শূন্য।
অনেকেই মনে করতে পারেন, আওয়ামী লীগই তো আবার ক্ষমতায় আসবে, কাজেই ভোট দিয়ে লাভ কি। ভুলেও এ করম ভাবনাকে প্রশ্রয় দেবেন না। এই নির্বাচন কোনো দলের ক্ষমতায় থাকা না থাকার নয়। এই নির্বাচন বাংলাদেশের অস্তিত্বের। ধ্বংসের হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর এই নির্বাচন। এই নির্বাচনে আপনার একটি ভোট গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারে। আপনার ভোট নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আপনার রায়। আপনার ভোট বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ। অন্য যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে এই নির্বাচন তাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
যারা এক-এগারোতে বাংলাদেশে ‘অনির্বাচিত সরকার’ এনেছিলে এই ভোট তাদের শেষ যুদ্ধ। যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায় না, বাংলাদেশকে একটি পরনির্ভর রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়, এটা তাদের শেষ লড়াই। পশ্চিমাদের ভৃত্য সুশীলরা যারা বাংলাদেশকে একটি পরনির্ভর পশ্চিমাদের পুতুল রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়, এই নির্বাচন তাদের শেষ সুযোগ।
আপনি ৭ জানুয়ারি ভোট না দিলে আপনি অনির্বাচিত সরকারের পক্ষে। বিদেশি প্রভুদের পক্ষে। ভোট না দেওয়া মানেই আপনি গণতন্ত্র বিরোধী অপশক্তিকে ক্ষমতাবান করলেন। এই অপশক্তি ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বানচালের সবচেষ্টো করেছে। নির্বাচনের সব রং উৎসবকে ফ্যাকাসে করতে চেয়েছে। এদের ধারণা ছিল, এসব করলেই নির্বাচন থেকে সরে আসবে সরকার। ভয়ে কাঁপবে। ভয় যে আওয়ামী লীগ পায়নি তা নয়। আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতাই যে অজানা শঙ্কায় বিভ্রান্ত হয়েছিলেন, এত বোঝা যায় তাদের দায়িত্ব জ্ঞানহীন কথা বার্তায়। কিন্তু একজন অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছেন। গণতন্ত্রের জন্য সংবিধান সুরক্ষার ব্রত নিয়ে। তার নাম শেখ হাসিনা।
অনেকেই এমপি হবার দ্বার প্রান্তে, অনেকে মন্ত্রী হবারও খোয়াব দেখতে শুরু করেছেন। কিন্তু এই নির্বাচন যে হতে যাচ্ছে সব জাতীয় এবং আন্তজার্তিক বাধা ও ষড়যন্ত্র পেরিয়ে তার কারণ শেখ হাসিনা। তার অমিত সাহস, বিচক্ষণ দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই ৭ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই নির্বাচনে তাই আপনার নিরপেক্ষ থাকার কোনো সুযোগ নেই।
আপনি কার পক্ষে? আপনি কি চান বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের অনাকাঙ্খিত নিষেধাজ্ঞা আসুক? আপনি কি চান, অনির্বাচিত সুশীলবাবুরা ক্ষমতা দখল করুক? আপনি কি চান, দেশ গতিহীন এক অন্ধকার হতাশার অধ্যায়ে প্রবেশ করুক? যদি না চান, তাহলে ৭ জানুয়ারি ভোট দিন। যেকোনো প্রার্থীর পক্ষে। আপনি আপনার ইচ্ছামতো প্রতীকে ভোট দিন। নৌকা, লাঙ্গল, ঈগল, ট্রাক, ডাব যেকোনো মার্কায়। আপনার ভোট প্রদানই হবে গণতন্ত্র রক্ষার সবচেয়ে বড় অস্ত্র ।
যারা প্রার্থী হয়েছেন, আল্লাহর ওয়াস্তে একদিনের জন্য ভালো মানুষ হন। ভোটারদের প্রতিপক্ষকে ভয়ভীতি দেখাবেন না। ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আসতে উৎসাহিত করেন। তাদের নির্ভয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে দিন। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ, কারো পক্ষ নেবেন না। কাউকে জেতানো কিংবা কারচুপি করে দেশের ভবিষ্যতকে অনিশ্চয়তার দিতে ঠেলে দেবেন না।
আর আমরা এই নির্বাচন কে বাংলাদেশে অস্তিত্ব রক্ষার নির্বাচন হিসেবে বিবেচনা করি। ভোট জনগণের উৎসবের দিন। আসুন সেই উৎসবে মেতে ষড়যন্ত্রকারীদের ‘না’ বলি।