বিশেষ প্রতিবেদক:
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে সমন্বিত একটি মঞ্চ বা ব্যানার গঠনের কার্যক্রম পিছিয়ে দিয়েছে বিএনপি। দলের ভেতরে ও বাইরে থেকে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসায় আপাতত প্রক্রিয়াটি স্থগিত বলে দাবি করেছেন দলের স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য। পাশাপাশি ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতির নতুন কোনও পরিবর্তন না হলে’ এই প্রক্রিয়াটি এগোনোর কোনও সুযোগ নেই। আপাতত যুগপৎ ধারায় সরকারবিরোধী কর্মসূচি দেওয়াই লক্ষ্য বিএনপির।
যুগপৎ সঙ্গীদের কারও কারও পর্যবেক্ষণ, বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বে বোঝাপড়ায় ব্যাপক সম্মিলন ঘটেছে। এ জন্য নির্বাচনের আগে বা পরে তাদের একসঙ্গে দেখা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে এর প্রভাব রাজপথে কতখানি পড়বে, তাও বিবেচনায় নিচ্ছে তারা।
বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচিতে যুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা মনে করছেন, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে জামায়াত যোগাযোগ স্থাপন করেছে এবং এক মঞ্চ গড়ার দিকে উভয়পক্ষের শীর্ষ একাধিক নেতা তৎপর। ফলে, যেকোনও সময়ই তাদের একসঙ্গে দেখা যেতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য ও দায়িত্বশীল অপর একজন জানান, আপাতত প্রক্রিয়াটি সামনে এগোচ্ছে না। দলের ভেতরে ও বাইরে থেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ও পরামর্শ আসায় আপাতত শীর্ষ নেতৃত্ব তা বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিচ্ছেন না। কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে মন্তব্য করবো না।’
গণতন্ত্র মঞ্চের দুই জন প্রভাবশালী সাবেক সমন্বয়ক বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, নির্বাচনের আগে যুগপৎ ধারায় কোনও পরিবর্তন আসছে না। তবে নির্বাচনের পর কী হবে, তা নিয়ে মঞ্চের কোনও দায় নেই। বিএনপি জামায়াতকে সঙ্গে নিলে স্বাভাবিকভাবেই গণতন্ত্র মঞ্চসহ আরও বেশ কয়েকটি দল যুগপৎ থেকে বেরিয়ে যাবে।
মঞ্চের একজন নেতা বলছেন, বিএনপি আন্দোলনে জামায়াতকে চাইছে এ কারণে যে তাদের নেতাকর্মীরা রাজপথে নামলে প্রতিরোধ সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, দাবি আদায়ে চাপ প্রয়োগ সহজ হবে। নির্বাচনের আগে অবরোধ বা হরতালেও দুই দল ঝুঁকি নিতে পারে। তবে কোনও কিছু বিএনপি খোলাসা করছে না।
গণতন্ত্র মঞ্চের সূত্র জানায়, বিএনপির স্থায়ী কমিটি, গণতন্ত্র মঞ্চসহ অন্যান্য বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে কর্মসূচি নিয়ে, কৌশল নিয়ে আলোচনা হলেও বিষয়বহির্ভূত সিদ্ধান্ত আসছে। একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জানানো হচ্ছে। এর ফলে, নির্বাচনের আগে আন্দোলনের স্বার্থে মঞ্চের অবস্থান তুলনামূলক উদার থাকলেও এর প্রভাব পড়তে পারে যুগপৎ কর্মসূচিতে।
‘যেটুকু মিলবে সেটুকু করবো। মঞ্চের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক গ্রাজুয়ালি হালকা হয়ে যাচ্ছে। সাত তারিখের পর আর যুগপৎ কন্টিনিউ না-ও হতে পারে। ডিসিশনগুলো একতরফাভাবে হচ্ছে। হুবহু পালন করতে পারছি না।’ বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে এভাবেই বলছিলেন মঞ্চের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা।
বিএনপির অনেক নেতা মনে করছেন, আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিগত অভিজ্ঞতাগুলোকে দলীয় শীর্ষ নেতৃত্ব আমলে না নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে শেষ মুহূর্তে এসে ঠেকে যাচ্ছে বিএনপি। বিশেষত, ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর, এ বছরের ২৮ জুলাই মহাসমাবেশ, ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখ ঘেরাও, ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করা হচ্ছে না বলে দৃশ্যমান।
দলীয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বেশ কয়েকটি টেস্ট কেস সামনে দিয়েছে বিএনপিকে। সেসব ঘটনায় বরাবরই বিএনপি শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেনি। সূত্রের ভাষ্য, ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর আদালতের আদেশে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে তার স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে উচ্ছেদ; ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তাকে কারাগারে প্রেরণ; এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে নেতাকর্মীদের টেস্ট করেছে সরকার।
সূত্র উল্লেখ করে, ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাড়ে চার ঘণ্টা নয়া পল্টনের দলীয় অফিসের নিচে একা বসে রইলেও নেতাকর্মীরা ছিলেন উদাসীন। পাশে স্থায়ী কমিটির দুজন নেতার বাসভবন ও অফিস থাকলেও তারা ছিলেন উধাও। সবশেষ গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় পণ্ড মহাসমাবেশ ও পরদিন বিএনপির মহাসচিবসহ প্রথম সারির অর্ধশতাধিক নেতা গ্রেফতার হলেও দলের প্রতিক্রিয়া ছিল স্বাভাবিক। নীতিনির্ধারণী কোনও নেতা প্রকাশ্যে মির্জা ফখরুলের গ্রেফতার ও তার কারাবরণ নিয়ে বক্তব্য দেননি।
একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে মঞ্চের কারও কারও মত, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, মিডিয়া সেলের প্রধান জহির উদ্দিন স্বপন কারাগারে এবং ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু দেশের বাইরে থাকায় বিএনপির ডানপন্থি অংশটি এখন সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখছে। সে কারণে স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হলেও মঞ্চের সঙ্গে বা অন্যান্য জোটের সঙ্গে আলাপ হলেও তার কোনও প্রভাব সিদ্ধান্তে প্রতিফলিত হয় না। সবশেষ জামায়াতকে যুক্ত করার চেষ্টাটিও ডানপন্থি অংশের বলে দাবি করে সূত্র।
তবে বিএনপির ভেতরের অংশের সঙ্গে গণঅধিকার পরিষদ, ১২ দলীয় জোট, গণফোরাম-পিপলস পার্টি প্রক্রিয়াটিতে সায় দিলেও অন্য দলগুলো নেতিবাচক অবস্থান নেয়। এমনকি গণতন্ত্র মঞ্চের একজন নেতা প্রক্রিয়াটির পক্ষে সায় দিয়েছেন।
জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা সাইফুল হক বলেন, ‘সব বিরোধী দলের রাজপথে থাকার মধ্য দিয়ে ঐক্য গড়ে উঠেছে। গণতন্ত্র মঞ্চ রাজপথের ঐক্যকে ধরে রাখবে। আমরা স্ব-স্ব ও যুগপতের অবস্থান থেকে আন্দোলন জোরদার এবং আরও সমন্বয় ও সংহতি গড়ে তুলতে চাই, যেন মানুষের আস্থা ফেরানো যায়। মানুষ দেখতে চায় সব বিরোধী দল এক হচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোকে নানা বিষয় বিবেচনায় রাখতে হয়।’
‘পরিস্থিতি যে দাবি করবে; সে ধরনের ঐক্য গড়ে তুলবেন’ রাজনৈতিক নেতারা সে ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন বলে আশা করেন সাইফুল হক। জামায়াত ও বিএনপির রাজনীতির ঘনিষ্ঠ একজন পর্যবেক্ষক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত মঞ্চ এখন হচ্ছে না আপাতত। আর তারাও (জামায়াত) বুঝেছে তাদের অবস্থান। এখন তারাও চাইছে না।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটি ও যুগপৎ ধারায় যুক্ত দলগুলোর নেতারা জানান, সাত জানুয়ারি নির্বাচনের আগে থেকে হরতাল বা অবরোধ থাকবে। ৪৮ থেকে ৯৬ ঘণ্টার হরতাল ও পরবর্তী কর্মসূচিও থাকবে। তবে নির্বাচনের আগে কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ রাখার দাবি করেছেন কোনও কোনও নেতা।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নির্বাচনের পরও কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।’
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা জোনায়েদ সাকি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা এই একতরফা পাতানো নির্বাচনে ভোট না দিতে জনগণকে আহ্বান জানাবো। শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন বাতিলের দাবিতে কর্মসূচি চলমান আছে। শান্তিপূর্ণ আরও কর্মসূচি আসবে।’
১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘নির্বাচনের পরও আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। কন্টিনিউ করবো। ১৪ সালে বা ১৮ সালে যে ভুল করা হয়েছে, তা হবে না। এবার আন্দোলন চলবে শেষ দেখা পর্যন্ত।’
প্রসঙ্গত, গত ২৮ অক্টোবর নয়া পল্টনে পুলিশের অভিযানে মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর ২৯ অক্টোবর থেকে চার দফা হরতাল ও ১৩ দফা অবরোধ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি।
এরপর লিফলেট ও গণসংযোগের জন্য তিন দিনের কর্মসূচি দেয়। সবশেষ বৃহস্পতিবার (২৮ ডিসেম্বর) দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ পঞ্চম দফায় শুক্রবার (২৯ ডিসেম্বর), শনিবার (৩০ ডিসেম্বর) লিফলেট বিতরণ ও গণসংযোগ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।
উল্লেখ্য, আগামী রবিবার (৩১ ডিসেম্বর) একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাঁচ বছর পূর্তি।